|
মানুষ নাকি ধর্ম, কোনটা বড়? – রেজানুর রহমান
আমার বিশ্বাসের সাথে অন্যজনের বিশ্বাস এক নাও হতে পারে। তাই বলে তাকে আমি হত্যা করব? এমন কথা কোনো ধর্মেই নেই। বরং সব ধর্মেই পরমত সহিষ্ণুতার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। আমি নিজের ধর্ম পালন করব। অন্যকেও তার ধর্ম পালনের সুযোগ করে দিব। আমার ধর্মীয় চর্চার পরিবেশ এমন ভাবে গড়ে তুলব যাতে অন্য ধর্মের অনুসারিরা সহজেই আমার ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমার ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। গ্রামের মসজিদে আজান দিতেন একজন মৌলভী। মক্তবে পড়াতেন। তার আচার ব্যবহার এতটাই অমায়িক ছিল যে গ্রামের সবাই তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করত। আমাদের গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা পাড়া ছিল। একদিন ওই পাড়ায় একটি বাড়িতে আগুন লাগে। গ্রামের মানুষ যে যেভাবে পারে আগুন নিভানোর জন্য ছুটে যায়। গ্রামের সম্মানিত ওই মৌলভীও ছিলেন সবার সাথে। আগুন নেভানোর জন্য নিজে পুকুর থেকে বালতি ভর্তি পানি বয়ে নিয়ে গেছেন। অন্যকে আগুন নেভানোর ব্যাপারে সাহসও যুগিয়েছেন। সেদিন দেখেছিলাম বাড়িটি কার, হিন্দু না মুসলমানের একথা না ভেবে গ্রামের সব মানুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নেভাতেই ব্যস্ত ছিল। আর আজ ৫০ বছর পর একি দেখছি? এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়। লুটপাট করে। এটা কিসের আলামত? একটু খেয়াল করলেই হয়তো অনেকের মনে পড়বে। এ তো কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। মৃত ব্যক্তির নামাজে জানাজা হচ্ছে। পাশেই সবার পেছনে মাথা নিচু করে উদাস নয়নে বসে আছেন একজন ব্যক্তি। তিনি হিন্দু। যিনি মারা গেছেন তিনি মুসলমান। দু’জন পরম বন্ধু ছিলেন। মুসলমানের জানাজায় হিন্দুরা অংশ নিতে পারে না। তাই হিন্দু ব্যক্তিটি জানাজার পাশেই বসে আছেন। বন্ধুর জন্য কাঁদছেন। এটাই হলো প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি। কে মুসলমান কে হিন্দু এটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মানুষ। তাহলে মানুষ কেন মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়? পীরগঞ্জের উত্তরপাড়া। জেলে পাড়া বলে পরিচিত। একদল নিরীহ মানুষের বসবাস। একথা স্বীকার করতেই হবে দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের মানুষ খুবই সহজ সরল প্রকৃতির। কে হিন্দু, কে মুসলমান-এ বিভাজন কারও মধ্যেই তেমন একটা রেখাপাত করে না। অথচ এ অঞ্চলেই একদল হিন্দুর বাড়িতে প্রকাশ্যে আগুন দেওয়া হলো। অভিযোগ কী? অভিযোগ হলো হিন্দু পাড়ার এক তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রতি অবমাননাকর একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে। অবশ্যই এটি অন্যায় কাজ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। এজন্য দেশের আইন আছে। দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমরা শাস্তির দাবি করতে পারি। তা না করে আমরা কি একটা গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারি? বাড়িঘরে লুটপাট করতে পারি? না পারি না। অথচ এটাই ঘটেছে পীরগঞ্জের উত্তর পাড়ায়। অভিযুক্ত তরুণের বাড়ি প্রথমে ঘেরাও করা হলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বিক্ষোভ কারীরা হামলা করল বিপরীত দিকে অন্য বাড়িগুলোতে। প্রকাশ্যে বাড়িগুলোতে কেউ আগুন দিচ্ছে কেউ কেউ বাড়ির ভেতরে রাখা ধান, চাল, টাকা পয়সা, মোটরসাইকেল, গরু-ছাগলসহ গেরস্থালির খুনিনাটি অনেক কিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এ যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মহান ৭১ এর দুঃসহ স্মৃতির চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা। একদল মানুষ পৈশ্চাচিক উম্মততায় অন্য একদল মানুষের প্রিয় আবাসস্থলে আগুন দিচ্ছে, লুটপাট চালাচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে বাড়ি ঘর ছেড়ে রুদ্ধশ্বাসে যে যে দিকে পারে পালাচ্ছে অন্য একদল মানুষ। রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে ধানক্ষেত অথবা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে অসহায় মানুষগুলো দেখল দাউ দাউ করে পুড়ে যাচ্ছে তাদের বসতবাড়ি। পুড়ে যাচ্ছে স্বপ্ন পুড়ে যাচ্ছে বিশ্বাস। পুড়ে যাচ্ছে আপন ঠিকানা। এ যেন আরেক ৭১। সারারাত মানুষগুলো ধানক্ষেত আর জঙ্গলেই কাটিয়েছে। সাথে ছিল অবুঝ শিশু। বৃদ্ধ বাবা-মা। অন্তঃসত্ত্বা নারী। পরদিন ভোরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন মাইকিং করে তাদের পুড়ে যাওয়া বসতবাড়িতে ফিরিয়ে আনে। সহজেই অনুমেয় ভোরের এ দৃশ্যগুলো কতটা বেদনাবিধূর ছিল। পীরগঞ্জের জেলে পাড়ার মানুষ গুরোর অপরাধ কী? মোটা দাগে অপরাধ হলো তাদের ধর্মেরই একজন তরুণ আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে একটি আপত্তিকর মন্তব্য লিখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন কথা হলো আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম কী এতই দুর্বল যে একজন নাদান তরুণের কথায় সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? হ্যাঁ, ওই তরুণ অন্যায় করেছে। আমাদের উচিত ছিল তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া। সেটা না করে আমরা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিলাম। সহায় সম্বল লুট করলাম। এটা প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। ঘটনার বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় ধর্মকে অন্তরে লালন না করে দেশের অরাজকতা সৃষ্টি ও লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে অনেকেই ধর্মকে ব্যবহার করছেন। কুমিল্লা ও পীরগঞ্জের ঘটনা তারই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিদায় হজের বাণীতে কয়েকটি নির্দেশ উল্লেখ করতে চাই। বিদায় হজের বাণীতে মহানবী বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আঁধার যুগের সমস্ত কুসংস্কার, সব অন্ধ বিশ্বাস, সব অনাচার, আজ থেকে অবসিত হলো! জগতের সমস্ত মিথ্যা আজ থেকে বাতিল হয়ে গেল। আজ থেকে অবসান হলো সকল বৈরিতার। গোত্রে গোত্রে, মানুষে মানুষে হানাহানি, শোনিত-প্রতিশোধ আর অন্যায় সংঘর্ষ আজ থেকে নিষিদ্ধ করা হলো। আজ থেকে একজনের অপরাধের জন্য অন্যকে দণ্ড দেওয়া যাবে না। পিতার অপরাধের জন্য পুত্র কিংবা পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা যাবে না। খবরদার ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। এ বাড়াবাড়ির ফলেই অতীতের অনেক সমৃদ্ধ জাতি লুপ্ত হয়ে গেছে…। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী আদৌ মহানবীর এ নির্দেশ মেনে চলি? যদি নির্দেশ মেনেই চলতাম তাহলে পীরগঞ্জের জেলে পাড়ায় আগুন দিলাম কোন যুক্তিতে? সেখানে যদি কেউ দোষ করে থাকে তাহলে শাস্তি হওয়া উচিত শুধু দোষী ব্যক্তির। তা না করে আমরা একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিলাম কোন যুক্তিতে? মহানবী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। আমরা কী তাঁর এ নির্দেশ মানছি? প্রশ্নগুলোর জবাব প্রয়োজন। কার কাছে জবাব চাইব? তবে আশার কথা, কুমিল্লা, রংপুরসহ সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছে। ঘটনার আড়ালেও ঘটনা থাকে। দু’একজন গ্রেফতারের মাধ্যমেই যেন আসল ঘটনা আড়াল হয়ে না যায়-এটাই প্রত্যাশা সবার।
লেখক : রেজানুর রহমান, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক : আনন্দ আলো
Post Views:
৩১২
|
|