|
এবার হবে কি করোনামুক্তি – অরূপ তালুকদার
ঠিক এই মুহূর্তে আমরা ধারণা করতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবল থেকে আমরা অর্থাৎ এই পৃথিবীর মানুষ মুক্ত হতে পারব। তবে ঠিক কবে এবং কতটা মুক্তি মিলবে, সেটা কিন্তু এখন ঠিক বলা যাচ্ছে না। কারণ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, প্রায় দেড় বছর আগে প্রথম যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয় তখন আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এই সংক্রমণ স্বাভাবিকভাবে কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে এনে শেষ করা সম্ভব হবে। কিন্তু হয়নি। পরবর্তীকালে আমাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় এবং চীনেই এই করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম রোগীর মৃত্যু ঘটে। সময়টা ছিল ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি। তবে চীন সেই মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেছিল ১১ জানুয়ারি। ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে থাইল্যান্ডে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ‘বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে। ১১ মার্চ করোনা সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি (চঅঘউঊগওঈ) হিসেবে ঘোষণা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ৪ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা বলা হয়। তার ১০ দিন পরে অর্থাৎ ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মার্চের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়াতে শুরু করে এবং জুন মাস থেকে তীব্র আকার ধারণ করে। একটুকু প্রথম দিকের ইতিহাস। তবে এ সময় থেকেই বিশ্বব্যাপী মানুষ করোনা সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তা পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যা একসময় দেশে দেশে ভয়ঙ্কর রকম বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পাল্টে দেয়, শুরু হয় এক নতুন জীবনযাপনের ধারা, যার নাম দেওয়া হয় ‘নিউ নরমাল লাইফ স্টাইল’। তখন বিশ্বের কমপক্ষে ১১৪টি দেশের সঙ্গে আমরাও তার শামিল হয়েছি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত প্রাণঘাতী করোনা বিশ্বের প্রায় ৪৭ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আক্রান্ত করেছে কোটি কোটি মানুষকে। পরবর্তীকালে দেখা গেছে, পৃথিবীর সবচাইতে সব দিক দিয়ে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল করোনা সংক্রমণের সবচাইতে বড় আতঙ্কস্থল। কারণ হিসেবে বলা হয়, বিশ্বের সব থেকে উন্নত এই দেশটিতে করোনা সংক্রমণ শুরু হবার পরে সে দেশের মানুষ করোনা সংক্রমণকে একেবারেই পাত্তা না দেওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণ সেখানে মরণ ছোবল দিয়েছে। দিনের পর দিন হাজারো মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং লাখো মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। নিউইয়র্ক নগরীকে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত করেছে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণঘাতী করোনার প্রবল আক্রমণে মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এখনও সেখানে প্রতিদিন মৃত্যু ঘটছে দেড় হাজারের বেশি মানুষের। আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ। অন্যদিকে ব্রাজিল ও রাশিয়ায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। ভারতে প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ এখনও মারা যাচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, বিশ্বের কোনো কোনো দেশে করোনার দাপট আবার হয়তো নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের আইসিডিডিআরবির ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলাদেশি গবেষক ও বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী ম্যাগসেসে ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংলাপে বলেছেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হলেও হঠাৎ করে আবার যে বেড়ে যাবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। কারণ দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমে গিয়ে আবার বেড়ে গেছে কারণ অধিক সংক্রামক এই ভাইরাসটি যখন-তখন রূপান্তরিত হয়ে হঠাৎ কোনো দেশে পুনরায় প্রবল বিক্রমে ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে এসেছে। প্রমাণ কয়েক মাস আগে ভারতে ফিরে আসা রূপান্তরিত করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণ। তিনি বলেন, ‘যে যাই বলুক না কেন, কোনোভাবেই এখনও কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা যাবে না। অন্ততপক্ষেক্ষযতদিন পর্যন্ত আমাদের হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত না হয়।’ দেশ-বিদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সব সময়ই বলে আসছেন যে, করোনা আক্রান্ত প্রতিটি দেশের সব মানুষকে নিজ এবং পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনেই প্রচলিত সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে অন্তত আরও দুবছর। যতদিন পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত না হয়। তবে এর পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে টিকা নিতে হবে। কারণ ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধে একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষেধক হচ্ছে করোনা প্রতিরোধক ভ্যাকসিন। প্রকৃতপক্ষে এর বিকল্প এখনও অন্য কিছু আছে বলে মনে হয় না। আর সেজন্যই আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে যত শিগগির সম্ভব টিকার আওতায় আনতে হবে অন্যান্য অনেক দেশের মতো। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ইতোমধ্যে আমাদের দেশে টিকা গ্রহণকারীদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩.৬০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রথম ডোজ নিয়েছেন ২.১৬ কোটি এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১.৪৩ কোটি মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৪.১৯ কোটি মানুষ করোনা টিকার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। এদিকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশ তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট এগিয়ে গেছে বলে মনে হয়। আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন ট্রাকারগুলোতে এখনও বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নিচে রয়েছে। বাংলাদেশের নিচে রয়েছে শুধু আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলো। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত ১৮৩ দেশে ৫.২৬ বিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়া শেষ হয়েছে। বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে না পারলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সবাইকে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া জরুরি। কারণ তাতে টিকাগ্রহণকারী কেউ মারাত্মক কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে। এটা এখন প্রমাণিত সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়। ‘প্রয়োজনই আবিষ্কারের মূল উৎস’- এই প্রবচনই হয়তো টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাজ করেছে। কেননা মাত্র ১১ মাসে উৎপাদিত হয়েছে করোনার ভ্যাকসিন।
প্রফেসর সারাহ গিলবার্টের নেতৃত্বেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রথম উদ্ভাবিত হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এখন পর্যন্ত ৭৫টি টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকলেও মাত্র ১২টি টিকাকে জরুরি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যার মধ্য থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেছে মাত্র সাতটি টিকা। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সূত্র অনুসারে, ফাইজার ও মডার্নার এক ডোজ টিকা ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অক্সফোর্ডের টিকা ৬৪ শতাংশের বেশি সুরক্ষা দিতে পারে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তাতে বলা হয়েছে, এই সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আপাতত বুস্টার ডোজ স্থগিত রেখে করোনা আক্রান্ত প্রতিটি দেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, ‘জরুরি ভিত্তিতে নিম্ন আয়ের অর্থাৎ কম উন্নত তথা দরিদ্র দেশগুলোকে অধিক পরিমাণে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। কারণ তাতে বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।’
অরূপ তালুকদার
শব্দসৈনিক ও কথাসাহিত্যিক
Post Views:
১২৯
|
|