|
তিনি মানুষকে মূল্যায়ণ করতে জানতেন, সেজন্য সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম চলচ্চিত্রকার দিলীপ বিশ্বাস
সুব্রত বিশ্বাস : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম চলচ্চিত্রকার দিলীপ বিশ্বাস। তিনি সেলুলয়েডের কিংবদন্তিও। তাঁর হাত ধরে বাংলা ছবি পেয়েছে দারুণ নান্দনিকতা। অনেকে শুধুমাত্র চিত্রপরিচালক হিসেবে জানলেও তিনি ছিলেন একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, অভিনেতা ও গায়ক। ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে দিলীপ বিশ্বাসের। ষাটের দশকে গায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তবে কমেডিয়ান হিসেবে বেশ খ্যাতি ও জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন। তাঁর অভিনীত সফল ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে আনোয়ারা, সমাধান, স্বীকৃতি, নতুন নামে ডাকো, দুই ভাই, অতিথি, রংবাজ। প্লে-ব্যাক করেছেন বেশ কিছু ছবিতে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। বহু গুণে গুণান্বিত এ মানুষটি ১৯৪৫ সালে পিরোজপুরের চাঁদকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছিলেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে ‘জিঞ্জির’ ছবির মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে চিত্রপরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটে তাঁর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের তিন কিংবদন্তি অভিনেতা রাজ্জাক, আলমগীর ও সোহেল রানাকে একসঙ্গে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘জিঞ্জির’ চলচ্চিত্রটি। সেটি সে সময় অসাধারণ দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। এরপর তিনি নির্মাণ করেছেন বহু সুপারহিট চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-অনুরোধ, আসামী, বন্ধু, অংশীদার, আনারকলি, অস্বীকার, অজান্তে, অপমান, সমাধি, অপেক্ষা, অকৃতজ্ঞ ইত্যাদি। দর্শক নন্দিত এ নির্মাতা সর্বশেষ ২০০৫ সালে নির্মাণ শুরু করেছিলেন মায়ের মর্যাদা। এটি ২০০৬ সালে মুক্তি লাভ করে। প্রযোজক হিসেবেও সফল ছিলেন।
 দিলীপ বিশ্বাস ও পুত্র দেবাশীষ
প্রযোজক হিসেবে তাঁর ছিল গীতি চিত্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, এখানে চলচ্চিত্র প্রযোজনাসহ পরিবেশনও করা হয়। তাঁর পরিচালনার বেশির ভাগ ছবির প্রযোজনা তিনি নিজেই করতেন। এখানেও তিনি ব্যবসাসফল ও দর্শকনন্দিত। এর মধ্যে ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে এবং ‘অজান্তে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে অর্জন করেন দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
 ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিচ্ছেন দিলীপ বিশ্বাস
২০০২ সালে পুত্র দেবাশীষ বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ’ ছবিটি প্রযোজনা করেছিলেন। গুণী এই নির্মাতার দারুণ একটি বিষয় আজও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ভাবায়, আনন্দ দেয়। সেটি হলো নিজের পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে অধিকাংশের নামের আদ্যাক্ষর ‘অ’ হওয়ায় ঢাকার চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁকে নিয়ে আলোচনা, কৌতূহল ছিল সবার। ‘অ’ কে অনেকে অশুভ, অসফল ইত্যাদি মনে করলেও দিলীপ বিশ্বাস ‘অ’ কে শুভ এবং সাফল্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আপন দক্ষতা এবং যোগ্যতায়। তিনি সব সময়ই বলতেন, ‘চলচ্চিত্রের “অ” “আ”র বেশি শিখতে পারিনি, তাই এই নামগুলোর বাইরে যেতেও পারি না!’ চিত্রনির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বড় বাজেটে নামিদামি জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে জমজমাট নাটকীয় কাহিনির বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি নির্মাণে নিজস্ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছিলেন দিলীপ বিশ্বাস।
 জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হাতে বাঁ থেকে আলমগীর, শাবানা ও দিলীপ বিশ্বাস
দিলীপ বিশ্বাসের ছেলে চলচ্চিত্রনির্মাতা ও উপস্থাপক দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, ‘আজ আমার অনেক নাম হয়েছে, কিন্তু আজও আমি গর্ববোধ করি “দেবাশীষ বিশ্বাস” হিসেবে নয়, “দীলিপ বিশ্বাস”–এর সন্তান হিসেবে।’ প্রখ্যাত এ নির্মাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একটা সময়ে ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে দিলীপ বিশ্বাস মানেই ছিল সোশ্যাল সিনেমার মাস্টার মেকার। বড় বাজেটে নামীদামি জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে জমজমাট নাটকীয় কাহিনির বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি নির্মাণে নিজস্ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছিলেন দিলীপ বিশ্বাস। চলচ্চিত্রের অমর এই কারিগরের সৃষ্টি ও তাঁর কীর্তি এখনো সবার কাছে অমলিন।
সফল এ নির্মাতা শুরু করেছিলেন একজন প্যারোডি গায়ক হিসেবে। এখানে পেয়েছিলেন অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। ১৯৬৪ সালে বের হলো তাঁর গানের লং প্লে ডিস্ক। কিন্তু মন পড়ে ছিল চলচ্চিত্রে। সুযোগ এল। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের হাত ধরে ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের মাধ্যমে সিনেমা জগতে ঘটল অনুপ্রবেশ। চলতে থাকল একের পর এক প্লেব্যাক।
 জোকার ছবিতে দিলীপ বিশ্বাস
এরপর বহুসংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে পান সুখ্যাতি। যার মধ্যে ‘হাবুর বিয়ে’, ‘দুই ভাই’, ‘মোমের আলো’, ‘সন্তান’, ‘চেনা অচেনা’, ‘আনোয়ারা’, ‘সমাধান’, ‘জোকার’, ‘এখনই’, ‘চাবুক’, ‘আদর্শ ছাপাখানা’, ‘বিনিময়’, ‘সুরুজ মিয়া’, ‘স্বীকৃতি’ ইত্যাদি। প্রথম দিকে তিনি প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন জহির রায়হান, মুস্তফা মাহমুদ, বাবুল চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে। একসময় পুরোপুরি নির্মাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সালটা ১৯৭৬, মুক্তি পেল তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সমাধি’। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। ছবি সুপারডুপার হিট।
 ‘স্বীকৃতি’ চলচ্চিত্রে দিলীপ বিশ্বাস, উজ্জল এবং শাবানা
 বাবার চলচ্চিত্রের পোস্টারের সামনে নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস
শিল্পের বাইরে ব্যক্তি জীবনের দিলীপ বিশ্বাসও ছিলেন অনুসরণীয় একজন মানুষ, স্বামী, পিতা ও বন্ধু। তাঁর বিনয় মুগ্ধ করতো সবাইকে। তাঁর ভালোবাসার ক্ষমতা ছিলো দুর্দান্ত। তিনি মানুষকে মূল্যায়ণ করতে জানতেন। সেজন্য সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। জীবদ্দশায় কোনো এক আড্ডায় দিলীপ বিশ্বাস সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছিলেন দৈনিক মানবজমিনের সিনিয়র সাংবাদিক প্রয়াত মোহাম্মাদ আওলাদ হোসেন। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান দিলীপ বিশ্বাস।
Post Views: ০
|
|