প্রচ্ছদ » স্লাইডার নিউজ » হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা আজ
Saturday February 5, 2022 , 8:51 am
সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা আজ
মুক্তখবর ডেস্ক রিপোর্ট : হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা আজ। সরস্বতী পূজা বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। মাঘের হিমেল হাওয়া যখন হু হু করে বইতে থাকে, কুয়াশা জড়ানো রাত যখন সময়টাকে দীর্ঘায়িত করে, আমের মুকুল ও গাঁদা ফুলের গন্ধে যখন আকাশ বাতাস মুখরিত হয় ঠিক তখনই দেবী সরস্বতীর আবির্ভাব হয়। মা সরস্বতী হলেন কলা ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বাগদেবীর আরাধনা বা সরস্বতী পুজো তাই বাঙালি তথা আপামর ভারতবাসীর প্রাণের উৎসব।সর্বপ্রকার ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে এই পূজা সকল বাঙালির মনে যে বিকাশ ঘটায় তা বাঙালি জাতিকে সারা বছর জুড়ে জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার ইন্ধন জোগায়।
পূজার ইতিহাস
বর্তমানে এই পূজা কেবলমাত্র বাঙালি গৃহস্থের অন্দরমহলে অথবা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ থাকলেও কয়েক শতাব্দী আগে পর্যন্তও সারা বাংলার বুকে এই পূজা ধুমধাম করে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হতো। এই প্রসঙ্গে বর্ধমানের রাজার তত্ত্বাবধান প্রচলিত থাকা বিখ্যাত সরস্বতী পুজোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পূজা দর্শনের জন্য সমগ্র বাংলা তথা বাংলার বাইরে থেকেও জনসমাগম হতো। এ ছাড়া ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে জল দিয়ে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার তাড়ি এবং দোয়াত কলম রেখে পুজো করার রীতি প্রচলিত ছিল। তবে শহরের দিকে বিত্তশালীর ব্যক্তিরাই মা সরস্বতীর মূর্তি নির্মাণ করতেন ও আরাধনা করতেন বলে শোনা যায়।
দেবী সরস্বতীর বর্ণনা ও আচার আচরণ
সরস্বতী বৈদিক দেবী তবে এ যুগেও মা সরস্বতীর পূজা উপাচারের রীতি প্রচলিত আছে। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে সরস্বতী কেবল জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবীতে পর্যবসিত হলেন। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে দেবী হয়েছেন। প্রতিমাকল্পে দেবী সরস্বতী শ্বেতবর্ণা , দেবী শ্বেতপদ্ম ও শ্বেত রাজহংসের ওপর অধিষ্ঠান করে থাকেন। দেবীর পরিধানে থাকে শ্বেতবস্ত্র।দেবীর এক হাতে থাকে বীণা তাই দেবীর আরেক নাম বীণাপানি। দেবীর অন্য হাতে থাকে পুস্তক। দেবীর সর্বাঙ্গে শুভ্রতা বিরাজ করায় দেবীকে শুভ্রতা ও পবিত্রতার প্রতীক বলে মনে করা হয়।
প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে কথিত আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পাঠশালাগুলিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার পুঁথি ও দোয়াত কলম রেখে দেবী সরস্বতীকে অর্চনা করার প্রথা বিদ্যমান ছিল। এই তিথিতে ছাত্র ~ ছাত্রীরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, স্লেট ও দোয়াত কলমে বাগদেবীর পূজার্চনা করত। ‘ম্লেচ্ছ’ ভাষা হিসেবে ইংরেজি পরিগণিত হত বলে সরস্বতী পুজোর দিন ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল তবে গ্রামাঞ্চলে বিংশ শতাব্দীতেও এই প্রথার প্রচলন ছিল।
দেবীর আরাধনা
শাস্ত্রীয় বিধান মেনে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায় এবং তা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন, অভ্রআবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিস। বাসন্তী রঙের গাঁদা ও পলাশ ফুলও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল খায় না এবং পূজার দিন লেখাপড়া নিষিদ্ধ। পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, দোয়াত-কলম, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজান্তে সকলের মঙ্গল কামনার্থে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আপামর বাঙালির মধ্যে। তবে সাধারণত ছাত্রছাত্রীরাই বিদ্যায়িনী দেবীর পুজোয় মেতে ওঠে। তারা ভক্তিভরে দেবীর চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে এবং দেবীর কাছে জ্ঞান ও বিদ্যালাভের প্রার্থনা জানায়।
বাংলার সরস্বতী সংস্কৃতি
বর্তমানে বাংলার সরস্বতী সংস্কৃতি অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা স্বতন্ত্র। আনন্দ প্রিয় বাঙালি এই পুজোকে কেন্দ্র করে আত্ম সংস্কৃতির চর্চায় মেতে ওঠে । শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করা হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন খুব সকাল থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। প্রায় সব হিন্দু পরিবারে ই এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃ তর্পণের আয়োজনও করা হয়ে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও পরিবেশিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত আবার কোনও কোনও হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পর দিন অরন্ধন পালনের ও প্রথা রয়েছে।
সরস্বতীর পরিবার
শাস্ত্র অনুযায়ী, দেবী দূর্গা ও মহাদেবের কন্যা হলেন সরস্বতী। লক্ষ্মী–কার্তিক–গণেশের সহোদরা ভগ্নী। সরস্বতী সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সহধর্মিণী, পালনকর্তা বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী ও ধবংসকর্তা মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে “ত্রিদেবী” নামে পরিচিতা। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করতে সাহায্য করা।
বিভিন্ন নামে দেবী সরস্বতী
সরস্বতী বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া বাগদেবী, সারদা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, ভারতী প্রভৃতি নামে অভিহিতা।
পূজার আনন্দ
পূজার আগে
পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। পূজা উপলক্ষে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ও বিভিন্ন ক্লাবগুলিতে সুন্দর সুন্দর মণ্ডপ নির্মিত হয় । ছাত্রছাত্রীরা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মণ্ডপ সাজানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। পুজোর আগের দিন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা আনার কাজ চলে। কুমোর বা মৃৎশিল্পীরা ছোট বড় নানা মাপের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেন।
শুক্লা পঞ্চমী
শুক্লা পঞ্চমী র ভোরেই ছাত্রছাত্রীরা স্নান সেরে পরিষ্কার বা নতুন জামাকাপড় পরে পুজোর আয়োজন করতে থাকে। তারপর দেবীর পায়ের কাছে বই, খাতা, কলম রেখে পুরোহিতের বলা মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সবাই একসাথে দেবীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দেয়। নানা রকম ফুল দিয়ে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয় যার মধ্যে গাঁদা, পলাশ ফুল, বেলপাতা ইত্যাদি থাকে। ফলের মধ্যে থাকে-কুল, কমলালেবু, কলা, আপেল ইত্যাদি।
পুজোর দিন
পুজোর সময়ে কাঁসর ঘণ্টা ধ্বনি এবং ঢাকের আওয়াজে চারিদিকে গমগম করতে থাকে। ধূপও ধুনার সুগন্ধে একটা পবিত্র পরিবেশ তৈরি হয়। কোনো কোনো স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এদিন খিচুড়ি খাওয়ারও আয়োজন করে থাকে। ওই দিন বিকাল থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দেখার জন্য ভিড় জমে যায়। সন্ধ্যার সময় দেবীর আরতি হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নানা রকমের মানুষ ওই অনুষ্ঠানে সামিল হন।
বিসর্জন
সরস্বতী পুজো মাত্র এক দিনের পূজা তাই পূজার আনন্দ এক দিনেই শেষ হয়ে যায়। পরদিন সকালে পুরোহিত বিসর্জনের মন্ত্রপাঠ করেন ও তারপর চিড়ে ও দই মেশানো দধিকর্মা নিবেদন করে নিয়মবিধি সমাপ্ত হয়। পূজাশেষে সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। আর তারপর সেই বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সহজেই সরস্বতী মায়ের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে চলে আবার বিসর্জনের শেষে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ফিরে আসে।
উপসংহার
প্রতি বছরই দেবী সরস্বতীর আরাধনার দিনটি বিদ্যার্থীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকলে বিদ্যার আলোকে, বুদ্ধিমত্তায় চিরকাল সত্যের প্রতি অনুরাগী থাকার আশীর্বাদ চায়। মনে মনে হলে ও দেবীর কাছে সকলে যেন মিলিতভাবে বলে ওঠে, সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
সরস্বতী পূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।বাণীতে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছর ধরে এ ভূখণ্ডে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে একত্রে বসবাস করে আসছেন। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ তিথি বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে বিদ্যা ও শিল্পকলার দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকলেও করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এ বছর পূজামণ্ডপে সীমিত আকারে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার সব আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে। শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৭টা ৭ মিনিটে শুরু হবে পঞ্চমী তিথি। আগামীকাল রোববার সকাল ৭টা ৯ মিনিটে পূজার তিথি সমাপ্ত হবে। এদিন সকালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের বাসা ও পূজামণ্ডপে সরস্বতী পূজা হবে। পূজা শেষে ভক্তরা অঞ্জলি গ্রহণ করবেন। এদিন শিশুদের হাতেখড়িরও আয়োজন করা হয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব বিদ্যারদেবী শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজার আয়োজন করেছে। সকাল ৯টায় পূজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে করোনার কারণে সরকারঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ মেনে পূজার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি শ্রী শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কিশোর রঞ্জন মন্ডল। এছাড়া এবার জাতীয় প্রেসক্লাবেও পূজা অনুষ্ঠিত হবে।