Current Bangladesh Time
শনিবার এপ্রিল ২৭, ২০২৪ ৩:৩৮ পূর্বাহ্ণ
Latest News
প্রচ্ছদ  » স্লাইডার নিউজ » বরিশালের সাংবাদিক মুনির হোসেন ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ 
Wednesday November 24, 2021 , 9:15 pm
Print this E-mail this

মুনির হোসেন কলম হাতে ছিলেন আমাদের সমাজের বিবেক

বরিশালের সাংবাদিক মুনির হোসেন ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ


হেনরী স্বপন, অতিথি প্রতিবেদক : ২৫ নভেম্বর প্রয়াত মুনির হোসেনের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। সে ছিল রাজপথে থেকে উঠে আসা প্রগতিশীল রাজনীতিক এবং বরিশালের আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃত। মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই আমাদের কাঁদিয়ে ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বরের এই দিনে তাঁর মায়ালোক ছাড়িয়ে, হঠাৎ করেই চলে যান তিনি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাস্যময় এই যুবকের আকস্মিক চলে যাওয়ায় বরিশালের সাংবাদিক মহল আজও ব্যথিত। মুনির হোসেন কলম হাতে ছিলেন আমাদের সমাজের বিবেক। আর, তাঁর এই কলমই ছিল জ্বলন্ত মশালের আগুনে আঁধার চেরা আনন্দ। এই আনন্দকে পুঁজি করেই স্থানীয় সাপ্তাহিক লেকবাণী পত্রিকার মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছিল তাঁর সাংবাদিকতা জীবন। আর তাঁর সেই সময়কার প্রতিটি প্রতিবেদনই নাড়িয়ে দিত প্রত্যেক পাঠকের মন। কাঁপিয়ে দিত সমাজের বিবেক ও সকল কলুষতাকে। রাজনীতিক হিসেবেও সে ছিলেন সফল! সাধারণ মানুষের রাজনীতিবিদ। তা না হলে, কেনই বা আজও এতো মানুষ তাঁর গুণমুগ্ধতাকে স্মরণ করছেন? পিতা, আ্যাডভোকেট নেহাল হোসেন এবং মাতা, খালেদা বেগমের মেজ ছেলে মুনির হোসেনের জন্ম ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে হিজলার মেমোনিয়া গ্রামে। ৫ ভাই ৫ বোনের মধ্যে মুনির হোসেন ছিলেন পরিবারের চতুর্থ সন্তান। জীবদ্দশায় তিনি একাধারে যেমন রাজপথে থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির কথা বলেছেন, তেমনি কাগজের পাতায় নানা প্রতিবেদন লিখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন, দক্ষিণাঞ্চলের অনন্য এক সাহসি সাংবাদিক। আবার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ মুনির হোসেন বরিশাল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চাতালেও দাপুটে পদচারণার মাধ্যমে নিজের সংস্কৃতি প্রতিভার জানান দিয়েছিলেন। মুনির হোসেন বরিশাল নগরীর ব্রজমোহন বিদ্যালয় (বিএম স্কুল) থেকে এসএসসি পাশ করেন এবং তারপর বরিশাল সরকারী ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচ এস সি ও ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। বলা যায়, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তানী এ-দেশীয় হায়নাদের প্রতিরোধেও তিনি নিজেকে প্রাণপণ নিয়োজিত রেখেছিলেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরানোর বিরামহীন কাজে। তাঁর সময়ের রাজনীতিতে অযথা এতোই রক্তপাত ছিল, যা দেখে অবশ্যই বিচলিত থাকতেন সে, যার দৃষ্টান্ত তাঁর প্রতিবেদনের প্রতিটি লেখনির বিষয়তেই খুঁজে পাওয়া যায়। মুনির হোসেনের আগুনঝরা সেইসব লেখনীর মুখেই প্রবাহিত হত তাঁর সমস্ত প্রতিবাদী সত্তা ও স্রোতস্বিনী আবেগের নদী। যদিও, তাঁর লেখনিতে শুধু আবেগই নয়, আবেগের অধিক আবেগকে ছাপিয়ে উঠত মানুষের মৌলিক আধিকারের কথাগুলো। কখনো তরবারির চেয়েও ক্ষুরধার ছিল তাঁর কলমের যুক্তি ও মুক্তির একেকটি ঢেউ। সেইসব ঢেউ যেন সারিবদ্ধ হয়েই পল্লবিত হতো, যতোক্ষণ না প্রতিপক্ষ নির্দিষ্টভাবে পরাস্ত হয়েছে চুরমার করা ভাঙনেরর ধাক্কায়। কোন অপশক্তির কাছে মাথানত না করে মুনির হোসেন আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে গর্বিত করে গেছেন। বরিশালে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে, নিজের হাতে গড়া সাংগঠনিক সন্তান পালনের মতোন এই সংগঠনের কর্মী সমর্থক বাড়াতে কাজ করেছেন এবং তিনি তাঁর সময়ের রাজনীতিতে ঘোর আওয়ামী লীগার এবং আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ্’র ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।নগরীর অশ্বিনী কুমার হল অথবা বিবির পুকুরের দলীয় কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভরাট কন্ঠের অধিকারী মুনির হোসেন যখন বক্তব্য রাখতেন, তখন শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনতেন। পাশাপাশি বরিশালের অন্যতম নাট্য সংগঠন শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের একজন একানিষ্ঠ কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। মুনির হোসেন আবৃত্তি আর মঞ্চ সঞ্চালক হিসেবেও স্বল্প সময়েই বরিশালের সকলের নজর কেড়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে মুনির হোসেন বরিশালের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম জোট ‘বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মূলত নব্বইয়ের দশকে মুনির হোসেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন মানুষ হিসেবে রাজপথে সরব ছিলেন এবং সামাজিক সকল অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে এক লড়াকু সৈনিকও ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে মুনির হোসেনের সম্পাদনায় ‘ইতিবৃত্ত’ নামে বরিশাল থেকে একটি সাহসী ম্যাগাজিন বের হয়েছিল। একটা সময় এ পত্রিকাটি বরিশালবাসীর আশা আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়ে সকলের নজর কেড়েছিলেন। ত্যাগ তিতিক্ষা আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে গিয়ে একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক অথবা একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া মুনির হোসেন এ অঞ্চলের একজন সাংবাদিক নেতা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন বরিশালের অন্যতম স্থানীয় দৈনিক আজকের বার্তার বার্তা সম্পাদক। এক সময়ে বরিশালের বাইরে থেকে যখন একেএম মুস্তাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় দৈনিক প্রবাসী প্রকাশিত হতো, তখন মুনির হোসেন সেই পত্রিকার বরিশাল সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের বরিশাল সংবাদদাতা ও জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠের বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন। সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষার নেতৃত্বের গুণে তিনি একাধারে ১৯৯৫, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯ এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত বরিশাল প্রেসক্লাবের (বর্তমানে ‘শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্পষ্টবাদী মুনির হোসেন ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। এখানকার সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে সাংবাদ প্রকাশের দক্ষতা ও প্রতিবেদন তৈরির সুক্ষ্ম কৌশলগুলো ভালোই জানতেন তিনি। শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার বুঝতেন, শব্দ দিয়ে পত্রিকার পাতায় সাপের খেলা দেখানোর মতো আনন্দ দিয়ে পাঠক বাজিমাত করতে পারতেন। কারণ, লেখালেখিতে মুনির হোসেন কখনোই কোন সিরিয়াস বিষয়কে অতিরিক্ত করে তুলতেন না। তিনি সব সময়ই স্বাভাবিক থাকতেন, এটাই ছিলো তাঁর অন্যতম স্বভাব। যৌবনে কবিতা লিখেছেন। তাঁর অনেক কবিতাই বরিশালের পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন ছোট কাগজে ছাপা হযেছে। অসম্ভব মাধুর্যতায় ভরা ভরাট কণ্ঠ ছিল বলে, তিনি কোনও কবিতা পড়লে, মঞ্চে বক্তৃতা করলে, এমনকি আড্ডায় কথা বললেও মানুষ মন্ত্র-মুগ্ধের মতো শুনতো। ফলে, যে কোনও মূল্যেই কবিতা আবৃত্তি, গান ও নাটককে ও এর সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে আমাদের সামাজিক আগ্রগতির পথে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টায় বদ্ধপরিকর ছিলেন। মুনির হোসেন নিজে যেমনি স্বপ্ন দেখতেন, তেমনি তার কাছে থাকা মানুষগুলোকেও স্বপ্ন দেখাতেন। ১৯৯৬ সালে যখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন, তখন মুনির হোসেন ছিলেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের বরিশাল জেলা সভাপতি। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতৃত্ব পর্যায়ের নেতা হয়েও তিনি কখনোই স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে দেননি। বরং তিনি তাঁর পেশাকে সন্মান জানিয়ে ওই সময়ে একজন পুরোদস্তুর সাংবাদিক হিসেবে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। হয়তো অনেক স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯২ সালে মুনির হোসেন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ইতিবৃত্ত’ প্রকাশ আরম্ভ করেছিলেন। ওই পত্রিকাটির ১ম বর্ষের ২য় সংখ্যা পড়তে গিয়ে দেখেছি, সম্পাদকীয়’র ঠিক নিচে তিনি একটি কৈফিয়তও লিখেছিলেন।সেখানে তিনি লিখেছিলেন-‘গাদি গাদি সমস্যার কারণে এতোদিন ‘সাপ্তাহিক ইতিবৃত্ত’ নিয়মিত প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তাই ক্ষমা চাচ্ছি। তবে, এখন থেকে স্বল্প পরিসরে নিয়মিত প্রকাশ করার ইচ্ছে রাখি।’ কৈফিয়তের শেষাংশে তিনি লিখেছেন ‘হঠাৎ করে আবার যদি বন্ধ হয়ে যায় ইতিবৃত্তের প্রকাশনা, তখন দুঃখ পাবার কিছুই নেই। হয়তো আর ক্ষমা চাওয়া হবে না। তাই আগাম ক্ষমা চাচ্ছি।’ দীর্ঘ পনের বছর আগে মুনির হোসেন চলে গেলেও তাঁর স্মৃতি ধরে রাখতে এবং প্রয়াত বড়ভাই মুনির হোসেনের অপূর্ণ সব স্বপ্ন পূরণের লক্ষে এখন পর্যন্ত তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন স্নেহ-আদরে বেড়ে ওঠা ছোট ভাই এস এম জাকির হোসেন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পারিবারিক পরিমলে বেড়ে ওঠা জাকির হোসেনও নিজেকে বড় ভাইয়ের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর আর্দশের একজন সৈনিক মনে করে রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বরিশাল মহানগর কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন তিনিও এক অনন্য সাহসি সাংবাদিক নেতার মতোই বড় ভাই মুনির হোসেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সংবাদপত্র ও প্রেস ক্লাব নেতৃত্বের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন।বর্তমানে তিনি বরিশালের বহুল প্রচারিত দৈনিক মতবাদ ও দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকার সম্পাদক এবং শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ সভাপতি। বর্তমানে মুনির হোসেনের ইতিবৃত্ত ম্যাগাজিনের প্রকাশনা বন্ধ থাকলেও, ইতিবৃত্ত নামে এখন দৈনিক মতবাদ পত্রিকায় সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সাহিত্য সংস্কৃতিক আয়োজনের একটি পাতা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। সর্বোপরি একথা নির্দিধায় বলা যায় যে, মুনির হোসেনের সময়কালে বরিশালের সাংবাদিক বিগ্রেডের সারিতে প্রথম কয়েকজন তরুণদের মধ্যে সেই ছিল তখন আধুনিক ও সমসাময়িক চিন্তার অন্যতম একজন পেশাদারি সাংবাদিক। যদিও, অকাল মৃত্যুর কারণে, তখানকার সংবাদপত্রের প্যারেড গ্রাউন্ডে তাঁর আবস্থান খুব বেশি দিনের ছিল না বটে।কিন্তু তাঁর স্বল্প সময়ের সাংবাদিকতা জীবনের আপসহীন স্বাতন্ত্র ও আধুনিক বৈশিষ্টের লেখালেখি, গণমানুষের রজনীতি ও সংস্কৃতিক নানা কর্মকান্ড ও তাঁর জীবন ছোঁয়া সকল কীর্তিসমূহই মৃত্যুর পরে আজও তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেননা, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রেই বিচরণের ফলে, আজও সে সমানভাবে সবত্রই আলোচিত এবং উল্লিখিত হয়েই আছেন। কিংবা, এ-ও বলা যায়, তাঁর আনেক ভাল কাজের জন্যেই মৃত্যুর পরেও সে বেঁচে রয়েছেন আমাদের প্রত্যেকের বুকের পাঁজর দিয়ে তৈরি আন্তরের নিভৃত খাঁচায়।

বরিশাল মুক্তখবর পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী




Archives
Image
পিরোজপুরের কাউখালীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: চান মিয়ার শেষ বিদায়
Image
বরিশালে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় কথিত যুবলীগ নেতা মাসুদ গ্রেফতার
Image
২৪ বছর পর কারামুক্ত ওলিউলকে বাঁচার স্বপ্ন দেখালেন বরিশাল জেলা প্রশাসক
Image
আবারও ক্যান্সারে মৃত্যু, বড়সড় জরিমানার মুখে ‘জনসন অ্যান্ড জনসন’
Image
অকালেই নিভে গেল শিশু সামিয়ার জীবন প্রদীপ