Current Bangladesh Time
রবিবার অক্টোবর ৫, ২০২৫ ৬:৩৩ অপরাহ্ণ
Latest News
প্রচ্ছদ  » স্লাইডার নিউজ » আবেগ যখন বিবেকহীন – হানিফ সংকেত 
Thursday August 12, 2021 , 5:17 am
Print this E-mail this

একসময় বাংলাদেশে টিভি বলতে ছিল শুধু বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশন

আবেগ যখন বিবেকহীন – হানিফ সংকেত


মুক্তখবর বিনোদন ডেস্ক : একসময় বাংলাদেশে টিভি বলতে ছিল শুধু বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশন। তারপর আকাশ সংস্কৃতির বিস্তৃতির যুগে হুজুগে এবং নানান সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে অনেক চ্যানেল। আর এসব চ্যানেলের পর্দা ভরাতে প্রচার হচ্ছে অনেক খবর, অনেক অনুষ্ঠান, অনেক নাটক। সৃষ্টি হচ্ছে অনেক নাট্যকার, ডিরেক্টর, অ্যাক্টর, কন্ডাক্টর আর নিউজের জন্য শত শত রিপোর্টার। টিভি চ্যানেলের সংখ্যা যতই বেড়েছে, আশঙ্কাজনকভাবে নাটকের মান ততই কমেছে। নাটকের পাশাপাশি রাশি রাশি মানহীন অনুষ্ঠান কোন মানদন্ডে চলে তার মানে বোঝা কঠিন। নাটকের নায়ক-নায়িকাদের গর্বিত উচ্চারণ চ্যালেঞ্জিং নাটকে চ্যালেঞ্জিং চরিত্র। এসব চ্যালেঞ্জিং নাটক দেখে ‘চ্যালেঞ্জ’ শব্দটিও এর গুরুত্ব হারাতে বসেছে। এখন আবার একক নাটকের যুগ নেই, চলে সিরিয়াল-মেগা সিরিয়াল। এক পর্ব থেকে শুরু করে কয়েক শ কিংবা যত চান তত পর্ব গর্বের সঙ্গে অনেকেই করে থাকেন। একসময় এক ঘণ্টার একটি নাটক একটু বড় হলেই সেটাকে টেলিফিল্ম নাম দিয়ে চালানো হতো। এরপর টেলিফিল্মকে টেনেটুনে ফিল্মে রূপান্তর করা হলো। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার নাম দিয়ে শুরু হলো প্রদর্শন। তবে এসব প্রদর্শনে দর্শকের সেভাবে দর্শন না থাকলেও অর্থের আকর্ষণ থাকে প্রবল। ইদানীং এ সিরিজ নাটক ঈদকেও আক্রমণ করেছে। টেলিফিল্ম-মার্কা নাটকগুলোকে ভেঙে কয়েক টুকরা করে ছয় থেকে আট পর্ব বানিয়ে চ্যানেলগুলোয় চালান করে দেওয়া হয় ‘ঈদের বিশেষ ধারাবাহিক’ নাম দিয়ে। এখানে শিল্পী, নির্মাতা এবং চ্যানেল পয়সা পেলেও ১২টা বাজে দর্শকের। ঈদের ব্যস্ততম সময়ে কেউ যদি নাটকের একটি পর্ব না দেখে থাকেন তাহলে গল্পের কিছুই বুঝতে পারবেন না। তখন ভরসা ইউটিউব। কিন্তু ঈদের সময় টিভিতে সবাই মিলে সপরিবারে নাটক দেখার যে আনন্দ তা আর থাকে না। বলা যায়, চ্যানেলের নাট্যাকাশে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা। চলছে শিডিউল বেচাকেনার নাটক। ভর করেছে পিঁয়াজ-রসুনের মতো সিন্ডিকেট আর এজেন্সির উৎপাত। কিছু নির্বোধ পরিচালকের বিচরণ, মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পীর সিন্ডিকেটে নাট্যবাজার নিয়ন্ত্রণ।

Bangladesh Pratidinটেলিভিশনের পাশাপাশি এখন ইউটিউবের জন্যও নাটক বানান প্রযোজক, পরিচালক এবং মিডিয়া ব্যবসায়ীরা। উদ্দেশ্য সংস্কৃতি সেবা নয়, ব্যবসা। ভিউ এবং ভাইরাল। এদের কারণেই নাটক এখন মেধাহীনদের হাতে চলে যাচ্ছে। যাদের কোনো পরিমিতিবোধ নেই। উপযুক্ত শিক্ষা নেই। নাটকে কী বলতে হবে, কতটুকু বলতে হবে, কী বলতে হবে না- সেই বোধটাই নেই। তাই জরুরি হচ্ছে পরিচালকের এ সম্পর্কিত জ্ঞান এবং সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বোধ। আর তখনই সম্ভব সেলফ সেন্সরশিপ। যেটা এখনকার নাটকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এখন এজেন্সির কাছে চাঙ্ক বিক্রি করার কারণে চ্যানেলগুলোর প্রিভিউ করার সুযোগও থাকে না। শুধু টিভিতে একবার প্রচারের স্বত্ব দেওয়া হয়। এরপর সরাসরি চলে যায় ইউটিউবে। দু-তিন বার বিক্রির কারণে সিন্ডিকেটের শিল্পীদেরও লাভ হয়। এরা নাটকের কিংবা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। অনেকে বিষয়ই বোঝেন না। রাত জাগা পাখির মতো মধ্যরাত কিংবা ভোররাত পর্যন্ত শুটিং করে সকালে ঝিমুতে ঝিমুতে গাড়িতে করে বাড়িতে ফেরেন। দুপুরের পর কিংবা সন্ধ্যায় এদের শিফট শুরু হয়। এদের নির্দেশনা অনুযায়ী নাটক নির্মাণের জন্য ক্যামেরাম্যাননির্ভর কিছু পরিচালক থাকেন।

টেলিভিশনের সেই সোনালি যুগ থাকলে এখনকার এ সিন্ডিকেট-মার্কা শিল্পীরা কখনই আবদুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী কিংবা মোস্তফা কামাল সৈয়দের নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পেতেন না। কারণ তারা গল্পনির্ভর নাটক করতেন, শিল্পীনির্ভর নয়। নাটকের প্রয়োজনে যাকে দরকার তাকেই নিতেন। লোকে বলত এটা আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক কিংবা আতিকুল হক চৌধুরীর নাটক। শিল্পীর নামে নাটক চলত না।

আর এখন এ সিন্ডিকেট-মার্কা শিল্পীরা নায়ক-নায়িকা মিলে দ্বৈত শিফট দিয়ে নিজেরাই খেটেখুটে নাটক বানিয়ে নেন। তারপর ওই কোম্পানিগুলো টিকটক, ফেসবুকসহ নানাবিধ ওটিটি প্ল্যাটফরমে দিয়ে ফেসবুকে নিজস্ব কমেন্ট বাহিনী লাগিয়ে দেয়। যাদের কমেন্টে বোঝানো হয়- এদের মার্কেট এখন চড়া। চটুল এবং সুড়সুড়ি দেওয়া সংলাপের কারণে একশ্রেণির দর্শকের কাছে এই সিন্ডিকেট-শিল্পীদের কদর রয়েছে। আর এদের কারণেই এসব নাটকের ভিউও হয়। আর এজেন্সিও ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিউ লক্ষ্য করে। মূলত এদের নাটকের মান নির্ধারিত হয় ইউটিউবের ভিউর মাধ্যমে। অথচ ‘ভিউ’ই যে নাটকের মান নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি নয় সেই বোধটাও এদের নেই। একটি শাড়ির দোকানে অনেক কাস্টমারই শাড়ি দেখেন কিন্তু কেনেন একজন। আগে যারা  শাড়িটিকে ভিউ করেছেন তারা কেউ-ই পছন্দ করেননি, তাই কেনেননি। অর্থাৎ ভিউ মানেই পছন্দ নয়- এ বিষয়টিও এদের মস্তিষ্কে নেই। চিত্তানন্দে এরা আত্মহারা। আর হবেনই বা না কেন, এদের পেছনে বানরনাচের মতো ডুগডুগি বাজানোর লোকের অভাব নেই। কিছু পত্রিকার অনলাইনে হামেশাই এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। চুক্তিটা যেন এমন ‘তোমরা আমাদের জন্য করবে- আমরা তোমাদের জন্য করব’, কিন্তু ওইসব অনুষ্ঠানের মন্তব্যের ঘরে যেসব কমেন্ট আসে তা নিজের লোক দিয়ে মুছেও বোধহয় শেষ করতে পারে না, দু-একটি থেকেই যায়। তার পরও লজ্জা হয় না।

আগে বিজ্ঞ সমালোচকরা প্রতিটি শিল্পীর অভিনয়, বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ, সেট, আবহ সংগীত সবকিছু নিয়েই সমালোচনা লিখতেন। যা দেখে শিল্পীরা সাবধান হতেন, শিখতে পারতেন। আর এখন চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগের মতো কিছু কিছু সাংবাদিকও ইউটিউবের ভিউ দেখে রিভিউ লেখেন। যে নাটকের যত ভিউ সেই নাটক নাকি তত হিট। এ-জাতীয় ভিউসর্বস্ব হিট নাটকের একটি হচ্ছে ‘ঘটনা সত্যি’ নামের অঘটন। যে নাটকের মূল বক্তব্য সত্য নয় মিথ্যা। এ নাটকটি প্রচারিত হওয়ার পর সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, নিন্দা জানিয়েছেন, শাস্তির দাবি তুলেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করেছেন নানান মন্তব্য। নাটকটি সম্পর্কে এসব ক্ষুব্ধ মন্তব্যের কিছু শব্দ হলো- অনাকাক্সিক্ষত, আপত্তিকর, কুৎসিত, নোংরা, দায়িত্বহীন, মহা অন্যায়, নিন্দনীয়। কেউ লিখেছেন- শিল্পীসমাজ লজ্জিত, কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ক্ষমার অযোগ্য। প্রশ্ন উঠেছে- এসব নাটক বানান কারা, এদের উদ্দেশ্য কী, এদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে কে? এসব নাটক চালান কারা, কীভাবে চালান, তাদের আদৌ মানদন্ড নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, নাকি ব্যবসাই মূল বিষয়? এসব নাটকের শিল্পীর ভূমিকা কী, শুধুই কি অভিনয় করা? ভিউ দেখেই আত্মতৃপ্তি? এদের যোগ্যতা বা মেধা কতটুকু? এদের নাটকে মা-বাবার চরিত্র দেখা যায় না কারণ মা-বাবা থাকলে পুরো নাটকে তাদের খুনসুটি করার সুযোগ থাকে না। আবার এরা নিজেরাও মা-বাবা হতে চান না। চরিত্রের প্রয়োজনেও এদের কোনো সন্তান থাকতে পারবে না। তাহলে ললিপপ-মার্কা ইমেজ থাকে না। অথচ এদের বেশির ভাগের ঘরেই ‘স্কুল গোয়িং’ ছেলেমেয়ে আছে। নিজেদের যতটা কচি বোঝাতে চান তারা ততটা কচি নন। এ শিল্পীরা দায় এড়ান কীভাবে?

সব মহলেই একটি কথা উচ্চারিত হচ্ছে- নাটক এখন দায়িত্বজ্ঞানহীন, মেধাহীন, বিবেকহীনদের হাতে চলে যাচ্ছে। আবেগ যখন বিবেকহীন হয়- তাদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়? শুধু পরিচালক বা শিল্পীই নন- যে চ্যানেলে এ নাটক প্রচারিত হয়েছে সেখানে তো অনেক কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা আছেন, তারাই বা কোন যুক্তিতে এ ধরনের একটি নাটক চালালেন?

অটিজম বলতে অনেকে মানসিক রোগ বোঝালেও এটা মূলত এক ধরনের স্নায়বিক বিকাশগত সমস্যা। এ সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলা হয়। কেউ বলেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা স্পেশাল চাইল্ড। অটিজমে আক্রান্তরা সামাজিক আচরণে দুর্বল হয়। এরা কারও চোখের দিকে সরাসরি তাকায় না। এরা অনেক জ্ঞানীও হয়। এরা রাগলে অভিযোগ করতে পারে না। কষ্ট পেলে প্রকাশ করতে পারে না। আত্মযন্ত্রণায় ভুগতে থাকে। তাই প্রত্যেক মা-বাবাকেই থাকতে হয় নানান চাপে। মানসিক, আর্থিক, পারিবারিক আর সামাজিক চাপ তো আছেই। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আমি এ অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলাম। একজন প্রতিবন্ধী শিশুকে সমাজের আর দশটা শিশুর মতো করে গড়ে তুলতে একজন মায়ের যে কতটা শ্রম দিতে হয় তা আমি এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি ছিল ‘পিএফডিএ ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার’-এর। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাজিদা রাহমান ড্যানি- যিনি তার স্নায়বিক প্রতিবন্ধী শিশুটিকে নিয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর সংগ্রাম করেছেন। তারপর নিজের শিশুর পাশাপাশি অন্য শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কারণ আমাদের দেশে স্নায়বিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সঠিক পরিচর্যার কোনো ব্যবস্থা নেই। নিজের সন্তান নিয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর সংগ্রাম করে তিনি বুঝেছেন সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ বা তৈরি করলে এ শিশুরাও পরিবারে, সমাজে বোঝা না হয়ে অংশীদার হতে পারে। তিনিও বিশ্বাস করেন- এ শিশুরা ডিজ্যাবলড নয়, ডিফরেন্টলি অ্যাবল। মায়ের কঠোর সাধনায় ড্যানির ২৫ বছর বয়স্ক সন্তান সিয়াম এখন চাকরি করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ১১তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছে। আমি দেখেছি এ সেন্টারে মা’দের করুণ অবস্থা, সংগ্রামের জীবন। অটিজম শিশুর কারণে অনেক মা-ই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। অনেক মা উচ্চশিক্ষিত হয়েও বাচ্চার কারণে চাকরি/ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন।

প্রতিটি অটিজম আক্রান্ত শিশুর মা-বাবার একটাই চিন্তা- মা-বাবা বা অভিভাবকের মৃত্যু হলে ওরা কোথায় যাবে? কার চোখে চোখ রেখে কথা বলবে, সেই চিন্তায় একজন মা যখন অস্থির থাকেন, সন্তানের জন্য ভালোবাসা চান, সহযোগিতা চান তখন সবার মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষগুলোরও সমাজের নানান ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার এ শিশুদের শারীরিক -মানসিক নিরাপত্তার জন্য সচেতনতা তৈরির কাজে বেশি বেশি করে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ এ প্রতিবন্ধী শিশুরা অনেক সময় ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, উত্ত্যক্তের শিকার হয়, অনেকেই তাদের সামাজিকভাবেও হেয় প্রতিপন্ন করে। যা করা হয়েছে তথাকথিত নাটক ‘ঘটনা সত্যি’তে। তাই ‘ঘটনা সত্যি’ নাটকে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে তা কেউ মেনে নিতে পারেননি।

একটি নাটক তৈরি হয়ে প্রচার হওয়া পর্যন্ত অনেক ধাপ পেরোতে হয়। নাট্যকারের লেখা, পরিচালকের দেখা, শিল্পীদের পড়া, শুটিং করা, সম্পাদনা ও মিউজিক করতে গিয়ে বারবার দেখা, সিন্ডিকেট-শিল্পীদের দেখিয়ে ছাড়পত্র নেওয়া, এরপর চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি কিংবা কর্তৃপক্ষ দেখে তা প্রচার করা। প্রশ্ন হচ্ছে, এত ধাপেও কারোরই কি বিষয়টি নজরে পড়েনি? চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বলেছেন তারা বিতর্কিত ভয়েস ওভার ফেলে দিয়েছেন অর্থাৎ নাটকটি তারা প্রিভিউ করেছেন। যদি করেই থাকেন তাহলে কি তারা নাটকটি দেখে বুঝতে পারেননি, নাটকটিতে কী বার্তা যাচ্ছে? নার্স এসে কোন ধরনের চাইল্ডের কথা বলেছে? নাটকের শেষে নায়িকা চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে কী সংলাপ বলেছে?

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন করার সুবাদে আমার সঙ্গে বেশ কজন প্রতিবন্ধী শিশুর মায়ের কথা হয়েছে। ফেসবুক লাইভে এসেও তারা বলেছেন, এ ব্যাপারে ক্ষমা চাওয়া বা ক্ষমা করার মতো অবস্থা নেই। কারণ ‘ঘটনা সত্যি’ নাটকে একটি ভয়ংকর বার্তা দেওয়া হয়েছে, যে বার্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো মায়ের কান্না। অটিস্টিক যুবক সিয়ামের মা সাজিদা রাহমান ড্যানি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই বক্তব্য মানহানিকর। এতগুলো ধাপ পার হয়ে প্রচারিত নাটকে এমন স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয়টি কি কারোরই নজরে পড়ল না!’

প্রচারের পর বিষয়টি টেলিভিশন-সংশ্লিষ্ট কিছু সংগঠনের নজরে পড়লেও কেউ কেউ এটাকে ‘আপত্তিকর বার্তা’ ও ‘দায়িত্বহীনতার’ পরিচয় উল্লেখ করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। যে কারণে তা অনেকের কাছেই দায়সারা মনে হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু একটি শক্তিশালী চ্যানেল এর সঙ্গে জড়িত এবং ব্যবসার স্বার্থে অনেক পরিচালক-প্রযোজকেরই এ সিন্ডিকেট-শিল্পীদের প্রয়োজন, তাই কেউ কেউ আবার ‘ভুলবশত করেছে’ বলে ক্ষমা করার পক্ষেই মত দিয়েছেন। কিন্তু যাদের ভুলের কারণে এ নাটকটি ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে এবং ডাউনলোড করে ‘ভিউ’ পেতে অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন নামে আপলোড করছে, আর এসব যখন সেই মায়েরা এবং তাদের আত্মীয়-পরিজন দেখছেন তাদের মানসিক অবস্থা কী হচ্ছে তা কি কেউ ভেবেছে? এ শিল্পী-কলাকুশলীরা কত হাজার হাজার প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ের মা-বাবা-ভাই-বোনকে মানসিকভাবে আঘাত দিয়েছেন তা কি তারা ভেবে দেখেছেন? এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন অভিনেত্রী লিখেছেন- ‘পার পেয়ে যাওয়া তদের জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে গিয়েছে। তবে এবার সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।’ এ ভিউ কামানো উদ্ভট -কদর্য নাটকটির এ বার্তা প্রদানের সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধেই শাস্তির দাবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ প্রায় সব মহলেই। একজন শিল্পী যথার্থই লিখেছেন- ‘শিল্পী হওয়া তো দূরের কথা, ভিউ আর ফলোয়ারের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা বোধহয় মানুষও হতে পারলাম না।’

শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনেও অনেকের সন্তানও এ স্নায়বিক বিকাশগত সমস্যায় আক্রান্ত কিংবা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তারাও দেশের প্রচলিত আইনে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন। বিশিষ্ট অভিনেতা মঞ্চসারথি আতাউর রহমান তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন- ‘মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তানেরা আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের সন্তান। তারাই সবচেয়ে সৃজনশীল এবং দেশপ্রেমিক। স্টিফেন হকিং যৌবনকাল থেকে দৈহিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়েও বিশ্বের সেরা থিওরিটিক্যাল পদার্থবিদ। কেবল ক্ষমা চাইলে হবে না। যারা ওদেরকে পাপের ফল হিসেবে নাটক/চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করেছে, আমি দেশের আইন অনুযায়ী ওদের শাস্তি দাবি করি।’

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ৩৭ (৪) ধারা অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধের শাস্তি অনধিক তিন বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। সুতরাং আইন যেখানে আছে সেখানে মাফ চাওয়ার গুরুত্ব কতখানি? আমরা ভুলে যাই কোমলমতি বিশেষ এ শিশুদের শারীরিক/মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে নয় বরং তাদের ও তাদের পরিবারের প্রতি সমাজের এ ধরনের নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই এরা কষ্ট পায়। ‘ভুলবশত’, ‘অসাবধানতাবশত’, ‘আবেগের বশে’ বলে কেউ কেউ বিষয়টিকে ক্ষমা করার আওতায় নিয়ে আসতে চাইলেও আমাদের নাটকের মান রক্ষার স্বার্থে বিষয়টিকে ক্ষমার আওতায় নয়, বরং আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে যৌক্তিক। আইন থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগ না করে ভুল স্বীকার বা মাফ চাইলেই যদি পরিত্রাণ পাওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে এ ভুল অনেকেই করবে। আমরা কি সে পথ উন্মোচন করব? নাকি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব? তাই দাবি উঠেছে- এদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। তাতে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মায়েরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন।

পাদটীকা : আর একটি কথা, আমাদের দেশে কোনো কোনো ঘটনা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় লাইভের প্রতিযোগিতা, চলে ব্রেকিং নিউজ, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে টকশোগুলো। তারপর আরেকটি নতুন ঘটনায় চাপা পড়ে যায় সব। শুরু হয় নতুন ঘটনার লাইভ। ঘটনা মিথ্যার ‘ঘটনা সত্যি’ নাটকের এ নিন্দনীয় ঘটনাটিও যাতে মৌ-পিয়াসা-পরীদের ঘটনায় চাপা পড়ে না যায় এ অনুরোধ রইল। চিত্রনায়িকা পরীমণি আটকের ঘটনার পর এ নায়িকার রসালো গল্পই যেন বেশ কিছু চ্যানেলের প্রধান সংবাদপণ্য হয়ে উঠেছে। ব্রেকিং নিউজ এবং সরাসরির ছড়াছড়ি। এখানেও ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। আর বিবেকবোধসম্পন্ন কিছু কিছু চ্যানেলে এ বিষয়ে কোনো উল্লাস বা বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের কাছে প্রধান খবর ছিল করোনা এবং ডেঙ্গু রোগীদের ভয়াবহ চিত্র। যে করোনা মহামারীতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, আর এটাই হচ্ছে বিবেকের আবেগ।

লেখক : হানিফ সংকেত, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন




Archives
Image
রাজধানীর ধানমন্ডি লেক থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার
Image
মারা গেছেন সাবেক সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ
Image
তোফায়েল আহমেদের অবস্থা সংকটাপন্ন
Image
অক্টোবরে আসছে বাম দলগুলোর নতুন জোট
Image
বরিশালে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার ইয়াবা সেবনের ভিডিও ভাইরাল