|
মহল বিশেষে প্রশ্ন উঠেছে, গোটা বরিশাল শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহের তার সর্বত্রই কি গাছের নিচ থেকে বয়ে যাওয়া?
অন্ধকার বরিশালে ছাত্রলীগ নেতার ওপর খড়ক, কিন্তু বিদ্যুৎ কর্মকর্তা ঠিকই বহাল!
শাকিব বিপ্লব, অতিথি প্রতিবেদক : বর্তমান বরিশালে বিদ্যুৎ সরবারহের অবস্থা যেনো শরীর জুড়ে জ্বরে তাপ উঠা-নামার ন্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। হঠাৎ ঝড়-বাতাস অথবা হালকা মেঘের গর্জনেই শুরু হয় বিদ্যুত আসা যাওয়ার খেলা। এর ব্যতিক্রম ঘটছে না চলতি রমজান মাসেও। সিয়ামের এই মাসে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা থাকলেও নদীবেষ্টিত এই জেলার ক্ষেত্রে এ আদেশ উপেক্ষিত? এনিয়ে কথা বলার কেউ নেই। ইতিপূর্বে বিদ্যুেতর অব্যাবস্থাপনায় বিদ্রোহ করলেই হতে হয় মামলার আসামী নচেৎ ভিন্নমুখী হয়রানির নতুন নজির স্থাপিত হয়েছে। বিদ্যুত যাওয়ার কৈফিয়ত চাওয়ায় একজন ছাত্রলীগ নেতা সংগঠন থেকে বহিস্কারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাপের শক্তিমাত্রা পরখ করা গেলো চলতি সপ্তাহে ঐ ছাত্রলীগ নেতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের গতি মন্থর করে। কিন্তু আকস্মিক বিদ্যুৎ যাচ্ছে-আসছে এর ধারাবাহিকতার মাঝে গত মঙ্গলবার ৫ এপ্রিল রাতে বরিশাল শহর ও উপতলীর একাংশ দীর্ঘ প্রায় তিন ঘন্টা অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলেও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নেই। কেনো অন্ধকারে থাকছে বরিশাল? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যুত কর্তৃপক্ষের সেই খোঁড়া যুক্তি খাড়া করতে সময় লাগে নি। বরিশাল আমানতগঞ্জস্থ বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্র ২-এর একজন কর্মকর্তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, লাকুটিয়া সড়কে বিশালকায় একটি গাছ তারের উপর উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। গাছ কাটার কাজ চলছে, শেষ হলেই বিদ্যুৎ ফিরে পাওয়া যাবে। রাত পৌনে ১২ টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত দীর্ঘ এই সময় অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগাযোগ করা হলেই বলা হয় কাজ প্রায় শেষ, বিদ্যুৎ কিছু পরেই দিচ্ছি। দেই-দিচ্ছি প্রতিশ্রুতিতে এভাবে কেটে গেলো তিন ঘন্টা। বিদ্যুতের যন্ত্রনাদায়ক বিড়ম্বনায় গরমে অতিষ্ঠে লকডাউনের শহর বরিশালের পাড়া-মহল্লায় গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ নিজ বাড়ির আঙিনায় অথবা সম্মুখের সড়কে ঘুরে-ফিরেছে। একপর্যায়ে সেহরীর সময় ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে শেষ রাতে আচমকা ঝলক, ফিরে আসলো বিদ্যুতের আলো। মহল বিশেষে প্রশ্ন উঠেছে, গোটা বরিশাল শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহের তার সর্বত্রই কি গাছের নিচ থেকে বয়ে যাওয়া? মঙ্গলবার রাতে গাছ পড়ার সেই অযুহাত ছিলো আরও প্রবল। কিন্তু সেহরীর শেষে নামাজ পড়ে ঘুমন্ত বেলায় ভোর পৌনে ৭টায় ফের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আসে অর্ধঘন্টা পরে। এবারের ব্যাখ্যা, ওভারভোল্টেজ জনিত কারন। হাসপাতাল রোড এলাকা থেকে জানতে চেয়ে পরিচয় দেওয়া মাত্রই এই প্রতিবেদককে বলা হলো, সংশ্লিষ্ট এলাকার ট্রান্সফরমার ফল্ট করায় বিদ্যৎ শাটডাউন করে রাখা হয়েছে। বিদ্যুত গেলে এভাবেই প্রশ্ন দাতাদের ব্যাখ্যা দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়। গত ২৫ এপ্রিল চড়কাউয়া এলাকাসহ লাহারহাট এলাকা পর্যন্ত সেহরীর সময়কালে দীর্ঘতায় বিদ্যুৎ না থাকায় ঐ এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। এক্ষেতে পল্লীবিদ্যুতের ভাষ্য ছিলো, জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এলাকাবাসীর সেন্টিমেন্ট উপলদ্ধি করে নিজের ইমেজ বৃদ্ধি ও প্রভাব সৃষ্টিতে অতি উৎসাহী হয়ে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আশিকুর রহমান সুজন পরদিন বিকেলে স্থানীয় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে দলবল নিয়ে কৈফিয়ত চাইতে উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে চড়কাউয়া সাব-স্টেশনে কর্মরত লাইনম্যানদের সাথে বাক-বিতন্ডা থেকে সংঘাতে তাদের শারিরীক লাঞ্চিত করে। সেখানেই বিপত্তি। পল্লীবিদ্যুৎ-১ এর কার্যালয়ে এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় ও ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে শীর্ষ কর্মকর্তারা। দায়ের করে সুজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা। জানা গেছে এই ঘটনা বরিশাল মেট্রো পুলিশ কমিশনার কার্যালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে বিদ্যুত কর্মকর্তাদের দৌড়-ঝাপে। এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্রে হামলার ঘটনা ও মামলার অতীত অনেক উদাহরন রয়েছে। কিন্তু চড়কাউয়ায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া নিয়ে প্রতিবাদে সুজনের কপাল পুড়ল মামলার আসামী হওয়া ও দলীয় খড়ক নেমে আসায়। অর্থাৎ সামনে চলে আসে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সুজন পল্লীবিদ্যুতের মামলা নিয়ে ফাঁপড়ে পড়লে তার সংগঠনের জেলা নেতৃবৃন্দের একটি অংশ এই সুযোগে তাকে দল থেকে বহিস্কার সিদ্ধান্তের নির্দেশনা দিতে জেলা ও নগর আ.লীগের মধ্যে একটি চাপ তৈরীর প্রেক্ষাপট রচনা করতে সক্ষম হয়। নেপথ্যের কারন দুটি। এক-আভ্যন্তরীন দন্দ্ব, দুই-এই ছাত্রলীগ নেতার বেশকিছু বিতর্কিত কর্মকান্ড নিয়ে ক্ষোভ পুনজ্জীবিত হয় কোনো কোনো মহলে। কাকতালীয়ভাবে এসময় ছাত্রলীগ নেতা সুজন ত্রাণ বিষয়ক একটি ঘটনায় দলীয় অবদান তুলে না ধরার ক্ষোভে বরিশাল জেলা প্রশাসককে “আহম্ম্ক” বলায় ঘটনার সূত্র ধরে এই কটু’ক্তির দায়ভার পড়ে যায় নগর আ.লীগের উপর। ফলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২৯ এপ্রিল সুজনের রাজনৈতিক কবর রচনা হয় স্বপদসহ সংগঠন থেকে বহিস্কার ঘোষণায়। আভাস পাওয়া যায়,এতে উৎফুল্লিত হয় ছাত্রলীগের একটি অংশ পাশাপাশি পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট বন্দর থানা পুলিশ সুযোগ পেয়ে পুরনো ঝাল মেটাতে পিছু নেয় আটকে। সংগত কারনে সুজন এখন লাপাত্তা। বিপরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নতা নিয়ে বরিশালে কোনো কর্মকর্তা বা মাঠ পর্যায়ের এমন কোনা কর্মী শাস্তির আওতায় পড়েছে অথবা জবাবদিহিতা করতে হয়েছে, তার নজির নেই। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পর্যবেক্ষক মহল বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগ এতটাই শক্তিশালী যে, কৈফিয়ত দিতে হয়না। অযুহাত দিয়ে পার পাওয়া যায় সময়বিশেষ বিদ্রোহ দেখা দিলে। বিদ্যুৎ নিয়ে লুকোচুরিতে সাধারন মানুষ, বিশেষ করে গ্রীস্মকালে গরমে ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী এই অংশটি বিদ্যুৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিদ্রোহ করে খেসারত দেয় মামলার আসামী হয়ে আটক অথবা পলাতক থেকে। লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, জেলার দায়িত্বশীল কোনো দপ্তরের কর্মকর্তা অথবা রাজনৈতিকসহ প্রভাবশালী ব্যাক্তিবর্গের বাসায় আধুনিকায়নের এই যুগে আইপিএস থাকায় বিকল্প বিদ্যুৎ পাওয়ায় তাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা চাইতেও যায় না, উপরমহলে নালিশ জানানো থেকে নিরুৎসাহিত থাকতে দেখা যায়। তবে সময়বিশেষ সভা-সেমিনারে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই জানিয়ে বলতে চায় বিদ্যুৎ নিরবিচ্ছিনতা থাকলে তাদের দপ্তরই লাভবান হন সেবা দেওয়ার বিপরীতে জনগণকে বিল পরিশোধে। সেক্ষেত্রেও তাদের কাছে বন্দী সময়মতো বিদ্যুৎবিল পরিশোধে, নইলে ব্যাবস্থা। বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত বিদ্যুৎ বিভাগের জবাবদিহিতা না থাকলেও বিদ্যুৎ সেবার বিপরীতে বিল পরিশোধে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় শহরবাসী অন্ধকারে ডুবে থেকে কিছু সময় পর পরিত্রান পেলেও এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল রয়েছে যে ঝড়ো বাতাসে বিদ্যুৎ গেলে ৩দিনেও সংযোগ-সরবরাহ দেয়া হয় না। এই বিড়ম্বনা আর কষ্ট নিরবেই সইতে হয় অন্তত বরিশাল প্রেক্ষাপটে। লক্ষনীয় বিষয় হলো, বিদ্যুত বিচ্ছিন্নে নগরী অন্ধকার থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগসহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কার্যালয়ে এসি চলে, আলো জ্বলে। ফলে জবাব নেবে কে?
লেখক-জ্যোষ্ঠ সাংবাদিক
প্রধান সম্পাদক, অনলাইন পোর্টাল, বরিশাল বাণী
বিভাগীয় বার্তা সম্পাদক, দৈনিক প্রথম সকাল
সূত্র : ফেইসবুক – শাকিব বিপ্লব
Post Views:
৯৮
|
|