|
আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে চলছে দেদারছে বালু উত্তোলন
মুক্তখবর ডেস্ক রিপোর্ট : আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে চলছে দেদারছে বালু উত্তোলন। বেপরোয়া বালু উত্তোলনের কারণে ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়েছে বরিশালের বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যের চিঠি ও স্থানীয় জনসাধারণের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সত্ত্বেও সন্ধ্যার ৬টি পয়েন্টের বালুমহাল ইজারা দেয় বরিশাল জেলা প্রশাসন। সর্বোপরি উচ্চ আদালত এই বালু উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও তা কেউ মানছে না। ফলে ভাঙনে ইতিমধ্যে বিলীন হয়েছে নদীর দু’তীরের কয়েকশ’ একর ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ইলুহার বিহারীলাল একাডেমি স্কুলসহ বহু ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উজিরপুর-বানারীপাড়ার বিভিন্ন সূত্র, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দুই উপজেলার মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া সন্ধ্যা নদীর ভাঙনপ্রবণ খেজুরবাড়ী, নবগ্রাম, মসজিদবাড়ী, পূর্ব জিরাকাঠী, জম্বুদ্বীপ, ব্রাহ্মণকাঠী, পশ্চিম জিরাকাঠী ও মহিষাপোতা এলাকায় অনেক বছর বন্ধ ছিল বালুমহাল ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া। নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে এসব এলাকায় ভয়াবহ নদী ভাঙনের সৃষ্টি হলে ইলুহার ইউনিয়নের তৎকালীন ইউপি সদস্য পরিমল হালদার বালুমহাল ইজারা দেয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট দাখিল করেন। রিট ও আবেদনকারীর পক্ষে উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ দেয়ায় বন্ধ থাকে বালুমহাল ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া। পাঁচ-ছয় বছর ধরে এভাবে বালুমহাল ইজারা দেয়া বন্ধ থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বালুমহাল ইজারাবিরোধী লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন পরিমল। অভিযোগ রয়েছে যে প্রভাবশালী মহলের চাপেই নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন তিনি। যদিও এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি পরিমল। তার সরে যাওয়ার পর বালুমহাল ইজারা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর হলে তড়িঘড়ি ইজারার প্রক্রিয়া শুরু করে জেলা প্রশাসন। এই ইজারার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে এলাকার মানুষ। গত বছরের আগস্ট মাসে ভাঙনপ্রবণ ৮টি পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলনের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হলে এর প্রতিবাদে বানারীপাড়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ মিছিল ও মানববন্ধন করে সর্বস্তরের মানুষ। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে টেন্ডার প্রক্রিয়া স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন বানারীপাড়া-উজিরপুর আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে জেলা প্রশাসন। এমন পরিস্থিতিতে টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার জন্য হাইকোর্টে পৃথক ৩টি রিট করেন বানারীপাড়ার ইলুহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম, বানাড়ীপাড়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শরীফউদ্দীন আহম্দ ও ইলুহার ইউনিয়নের বাসিন্দা দীপক চন্দ্র হালদার। শুনানি শেষে শহিদুল ও শরীফউদ্দীনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে টেন্ডার প্রক্রিয়ার ওপর ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া দীপক চন্দ্র হালদারের রিট শুনানি শেষে বালুমহাল এলাকায় ইনজাংশন দেন দুই বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। এসব রিট ও ইনজাংশন জারির পরিপ্রেক্ষিতে টেন্ডার প্রক্রিয়া স্থগিত হলে নড়েচড়ে বসে ৬টি বালুমহাল ইজারা পাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা ঠিকাদার তথা প্রভাবশালী পক্ষ। রিট ও ইনজাংশনের বিরুদ্ধে আপিল করে তারা। আপিলে হাইকোর্টের দেয়া রায় ৮ সপ্তাহের জন্যে স্থগিত করে বিষয়টি পূর্ণ বেঞ্চে শুনানির নির্দেশ দেন আদালত। ৮ সপ্তাহের এই স্থগিতাদেশের সুযোগে টেন্ডার প্রক্রিয়ার বাকি কাজ সম্পন্ন করে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেয় জেলা প্রশাসন। এদিকে রিট আবেদন দাখিল করা দীপক চন্দ্র হালদার, শহিদুল ইসলাম ও শরীফউদ্দীন আহম্দ পূর্ণ বেঞ্চের শরণাপন্ন হলে সেখানে সবকটি রিট আবেদন ও আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের নভেম্বর মাসে আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশ বহাল রাখেন আদালত। ফলে টেন্ডার প্রক্রিয়া অবৈধ হওয়ার পাশাপাশি বালুমহাল ইজারা দেয়ার বিষয়টিও বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু এত কিছুর পরও অব্যাহত রয়েছে বালু উত্তোলন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০টি ড্রেজার নদীর তলদেশ থেকে দিন-রাত একটানা উত্তোলন করছে বালু। সেইসঙ্গে ১৮-২০টি বলগেটে এসব বালু পরিবহন করা হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। কেবল ইজারা পাওয়া এলাকাই নয়, জেলা প্রশাসন থেকে টেন্ডার হওয়া ৬টি পয়েন্টের বাইরেও যখন যেখানে খুশি সন্ধ্যা নদীর সেখান থেকেই বালু ওঠাচ্ছে ঠিকাদাররা। ফলে নদী তীরবর্তী উজিরপুর ও বানারীপাড়ার বিশাল এলাকায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে-খেজুরবাড়ি, নবগ্রাম, মসজিদবাড়ি, গোহাইলবাড়ি, বাংলাবাজার, নাটুয়ার পাড়, শিয়ালকাঠী, দান্ডেয়াট, ডুমুরিয়া, বরানগাতি, পূর্ব জিরাকাঠী, ব্রাহ্মণকাঠী, বাগরা ও জম্বুদ্বীপ এলাকায় ভয়াবহভাবে ভাঙছে সন্ধ্যা নদী। এসব এলাকায় হুমকির মুখে পড়েছে জম্বুদ্বীপ মসজিদসহ ইলুহার ইউনিয়নে থাকা শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বিহারীলাল একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। নদী ভাঙনের কারণে ঝুঁকির মুখে আছে বানারীপাড়ার শিয়ালকাঠী ফেরি ঘাট, মসজিদবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কালির বাজার ও জম্বুদ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনা। ভাঙনের এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে মিরেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আগের ভবন, মসজিদবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের আগের ভবনসহ আরও বেশ কিছু এলাকা। এর মধ্যে মসজিদবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দান্ডোয়াট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাটুয়ারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তরকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নলশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাঙ্গালীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি স্কুল ও কালির ৪ থেকে ৫ বার স্থানান্তর করতে হয়েছে। বর্তমানে নতুন করে শুরু হওয়া ভাঙনে এগুলো আবার হুমকির মুখে পড়েছে। বানারীপাড়ার পাশাপাশি উজিরপুর উপজেলার বহু এলাকাও পড়েছে তীব্র ভাঙনের কবলে। উজিরপুরের শিকারপুর, দাসেরহাট, হক সাহেবের হাট, লস্করপুর, ডাবেরকুলসহ বহু এলাকায় নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছে শত শত মানুষ। এমন পরিবারও রয়েছে যারা নদী ভাঙনের কারণে ৩-৪ বার ঘর বদল করেও ফের নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে। জম্বুদ্বীপ গ্রামের বাসিন্দা বিধবা ফুলবানু বিবি বলেন, সন্ধ্যার ভাঙনে এ পর্যন্ত ৩ বার বাড়ি হারিয়েছি। সর্বশেষ ভাঙনে বাড়ি হারানোর পর নানাবাড়িতে উঠেছিলাম। কিন্তু সে বাড়িও ভেঙে নিয়ে গেছে সন্ধ্যা। এখন নদীর পাড়ে রাস্তার ধারে ছাপরা ঘর তুলে প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে থাকছি। একইভাবে কয়েক দফা ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর কথা জানালেন দান্ডোয়াট গ্রামের সোহরাব হোসেন ও শিয়ালকাঠী গ্রামের আবদুল হকসহ সন্ধ্যা তীরের কয়েকশ’ মানুষ। বানারীপাড়া-উজিরপুরের সংসদ সদস্য শাহে আলম বলেন, ‘সন্ধ্যার ভাঙন ঠেকাতে জেলা প্রশাসনসহ প্রায় সব মহলে আবেদন-নিবেদন করেছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে শীত মৌসুমের ভাঙন ঠেকানোও মুশকিল হয়ে পড়বে। বালু উত্তোলন বন্ধ হলে হয়তো ভাঙনের তীব্রতা কিছুটা কমবে।’ বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ মেনে আমরা টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ করেছি। আবার আদালতের স্টে অর্ডারের পর আমরা টেন্ডার দিয়েছি। এখন যদি আদালত আবার স্টে দিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা বালু উত্তোলন বন্ধ করব। কিন্তু আদালতের এই সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা এখনও আমরা হাতে পাইনি।’ বানারীপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আবদুল্লাহ সাদি বলেন, ‘উচ্চ আদালত থেকে দফাওয়ারি ৩টি মামলা ও এসব মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিল। আমরা সেসব নোটিশের জবাব দিয়েছি। কিন্তু বালুমহাল ইজারা দেয়া বন্ধ কিংবা বালুু উত্তোলনে কোনো নিষেধাজ্ঞা পাইনি। পেলে অবশ্যই আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিতাম।’
সূএ : যুগান্তর
Post Views:
১৩৪
|
|