|
অপমৃত্যুর মামলাটি প্রক্রিয়াধীন-ওসি সাইফুল ইসলাম
সাংবাদিকের মৃত্যু : আত্মহত্যা নাকি হত্যা?
মুক্তখবর ডেস্ক রিপোর্ট : রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গাজী টিভির সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ (৩২) মরদেহ উদ্ধারের পর এটি আত্মহত্যা নাকি হত্যা—এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত মেলেনি। আজ বুধবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতের ময়না তদন্তের পরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, লাশের ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে মৃত্যু রহস্য। সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ’র বড় বোন রাবিতা সারাহ হাতিরঝিল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করবেন। হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান বলেন, সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ’র শরীরে কোন যৌন নিপীড়ন বা জখমের আলামত নেই। মৃত্যুর সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। মৃতের দেহ অচেতন অবস্থায় হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান ছিল। তাঁর শরীরে বাহ্যিক কোন আঘাত বা আঁচড়ের চিহ্ন নেই। কোন যৌন নিপীড়নের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে ময়না তদন্ত সহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। রাহানুমা সারাহ জিটিভির নিউজরুম এডিটর ছিলেন। ঢাকার কল্যাণপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ইসলামবাগ কৃষ্ণপুরে, বাবার নাম বখতিয়ার শিকদার। তিনি নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের সভাপতি। মৃতের বড় বোন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রাবিতা সারাহ বলেন, আমরা ভোর রাতে আমার বোন অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে আছে এমন সংবাদ পাই। পরে ঢাকা মেডিকেলে এসে দেখি আমার বোন আর নেই। তিনি আরও বলেন, আমার বোন হলিক্রস কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজে লেখাপড়া করেছে। সে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিল। আমার বাবা নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের সভাপতি। আমার বোনও একজন সাংবাদিক ছিল। কী কারণে এমন ঘটনাটি ঘটেছে এখন পর্যন্ত তা জানতে পারিনি। রাহানুমা সারাহ’র কয়েকজন সহকর্মীরা জানান, সহকর্মী হিসেবে তিনি অত্যন্ত একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কারো সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার বা জোরে কথা বলেননি। তবে কেন, কী কারণে এই ঘটনাটি ঘটেছে তা এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি। রাহানুমার জিটিভির আরেক সহকর্মী বলেন, রাতে তিনি হাতিরঝিলে গাছের নিচে বসে ছিলেন এবং একজন গার্ড তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত রাতে এখানে বসে আছেন কেন? তিনি বলেন, আমার গাড়ি আসবে, এলেই চলে যাব। এর কিছুক্ষণ পরই কেউ একজন পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে বলে শুনতে পান তিনি। তবে সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ’র মৃত্যুর ঘটনায় বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভির পক্ষ থেকে কোন কর্তৃপক্ষীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ গানের অনুরাগী ছিলেন। রাহানুমার ‘রূপকথারা কভার বাই সারাহ’ নামে সাউন্ড ক্লাউড আইডি ছিল। সেখানে ঢুকে বেশকিছু গানের লিস্টে পাওয়া যায়। রাহানুমার বন্ধু মেজবাহ উল আজিজ ফেসবুক স্টাট্যাসে জানান, ‘‘আমাদের হসন্ত ছিল কিন্নরকণ্ঠী গায়িকা। তার কাছ থেকে আমি বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট বাজানোর টিপস নিতাম। বিভিন্ন গানের প্রোপার সুর তাল কোনটা হবে সেগুলো শিখতাম। অপরাজিতা তুমি মুভির রূপকথারা গানটা পুরোটা আমাকে তুলে দিয়েছিল হসন্ত। আজও অই গান শুনলেই আমার ওর কথাই আগে মনে পড়ে।’ ভাল থেকো হসন্ত, একদিন আবার দেখা হবে। একসাথে আবার রূপকথার গান গাইব আমরা।’’ সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ’র বন্ধুদের বক্তব্য দীর্ঘদিন ধরে সারাহ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন কর্মস্থলে অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকলে অথবা কাজের পরিবেশ কর্মবান্ধব না হলে, বিষণ্ণতা, অপরাধবোধ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে টানাপোড়েন, বন্ধুর অভাব, সহযোগিতা করার মানুষ না থাকা ইত্যাদি থেকে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। বিষণ্নতার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি বুঝতে পারে তাদের বন্ধু বিষণ্নতায় আক্রান্ত তাহলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। মানসিক রোগ বা বিষণ্ননতার চিকিৎসা না করলে মানুষটি আত্মঘাতী হতে চাইবে। এই রোগটিকে এড়িয়ে যাওয়া বা অবহেলার সুযোগ নেই। সারাহর বন্ধু সৈয়দ নাজমুস সাকিব ফেইসবুকে লিখেছেন, “সারাহ অনেকদিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, চিকিৎসাও নিয়েছিলেন। সবাই তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল যে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।” বন্ধু ফাহিম ফয়সাল লিখেন, ‘‘আমার বন্ধুটা আর নেই, কাল রাতে শেষ কথা আমার সাথেই হয়েছিল। যদি বুঝতে পারতাম এটাই আমাদের শেষ কথা, তাহলে কখনোই যেতে দিতাম না!’’ সারাহর মৃত্যুতে শোকাস্তব্ধ তাঁর বন্ধু চিকিৎসক মেজবাহ উল আজিজ লিখেছেন, “যে ডিপ্রেশনের জন্য আমরা লড়াই করতে চেয়েছিলাম, সেই ডিপ্রেশনের কাছেই আজ আমরা আবার হারলাম। সুইসাইড প্রজেক্টে কাজ করতে চাওয়া, ডিপ্রেশন এর রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাওয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হাতিরঝিলের পানিতে নিথর ভেসে আছে আমাদের অপরাজিতা হসন্ত।” সায়েদ শুভ্র জানান, প্রেম করে সাত বছর আগে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিলেন। তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়নি। তবে বেশ কিছুদিন আগে থেকে রাহানুমা আলাদা হয়ে যেতে চাইছিল। তারা কাজী অফিসে গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তবে দেশের পরিস্থিতির কারণে তা আর করা হয়নি।

হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, মৃত সাংবাদিকের সুরতহাল ও ময়না তদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে জানা যাবে। ভুক্তভোগীর পরিবারে থেকে বড় বোন রাবিতা সারাহ একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করবেন। অপমৃত্যুর মামলাটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় জিটিভির সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ’র (৩২) মরদেহ উদ্ধার হয়। হাসপাতালে নিয়ে আসা পথচারী মো. সাগর বলেন, রাত পৌনে ১টার দিকে হাতিরঝিল প্রথম ব্রিজের নিচে লেকের পানিতে ওই নারী ভাসমান অবস্থায় ছিলেন। পাশেই তাঁর ব্যাগ ভাসছিল। পানি থেকে তুলে তাঁকে দ্রুত প্রথমে ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সেখানে কোনো চিকিৎসা দেননি তারা। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
হাতিঝিলেই মৃত্যু হয়েছে আরও সাংবাদিকের!
২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি গভীর রাতে সাংবাদিক হাবীব রহমান (৪০) নিহত হন। মোটরসাইকেল আরোহী সাংবাদিক হাবীব রহমান দুর্ঘটনায় নাকি হত্যার শিকার হন সে রহস্য দুই বছরেও জানা যায়নি। হাবীব রহমান সময়ের আলোতে আওয়ামী লীগ বিটে কর্মরত ছিলেন। একই বছর ৮ জুন হাতিরঝিল থেকে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের প্রডিউসার আবদুল বারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ প্লাজার পাশে ফজলে রাব্বি পার্কের পেছনে লেকের ধার থেকে ক্ষতবিক্ষত মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। একমাস পর সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আব্দুল বারীর মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তৎকালীন গোয়েন্দা-গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আব্দুল বারী খুনে কেউ জড়িত নন। তিনি ২০ টাকা দিয়ে ফল কাটার ছুরি কিনে নিজেই গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ ও বিভিন্ন শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।
সবশেষ মঙ্গলবার দিনগত রাত পৌনে ২টার দিকে হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় জিটিভির সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর (৩২) মরদেহ উদ্ধার হলো।
Post Views: ০
|
|