|
সময়ের সাথে সাথে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলছে
ভয়ংকর অপরাধে কিশোররা জড়াচ্ছে কেন !
ভয়ংকর অপরাধে কিশোররা জড়াচ্ছে কেন ! রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই কিশোরদের অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে।এমনকি তারা পরিকল্পিত হত্যার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে।সহপাঠী ও বন্ধুদের খুন করতেও দ্বিধা করছে না।বিশ্লেষকরা বলছেন,মূলত পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব,অভিভাবকদের ঔদাসীন্য ও আইনের যথাযথ ব্যবহার না থাকায় কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।রাজধানীতে অক্টোবর মাসেই কিশোরদের হাতেই খুনের শিকার হয়েছে তিন কিশোর। এর মধ্যে ২৭ অক্টোবর ‘জুনিয়র-সিনিয়র বিতর্কে’ রাজধানীর চক বাজার এলাকায় হাসান আলী নামের ১৪ বছর বয়সী জেএসসি পরীক্ষার্থী এক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করে একই এলাকার খোকা আলীসহ কয়েক কিশোর।ঘটনার পরদিন ২৮ অক্টোবর ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসানের মৃত্যু হয়।৮ অক্টোবর রাজধানীর পশ্চিম ধানমণ্ডি’র নিরিবিলি হাউজিং এলাকায় চাকু মেরে ইরফান নামে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে হত্যা করে তারই সমবয়সী রাজন নামে আরেক কিশোর।এর আগে ৬ অক্টোবর কদমতলীর রায়েরবাগের মুজাহিদনগর এলাকায় গ্রিল মিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম শিপনকে (১৮) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার বন্ধুরা।সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ২৫ আগস্ট দারুসসালামের টোলারবাগে ছুরিকাঘাত করে শাহিনকে (১৬),২২ আগস্ট ভোরে মিরপুরের উত্তর পীরেরবাগ এলাকায় খুন হন কবির হোসেনকে (২১),১৩ আগস্ট মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র মোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করে কিশোররা।এছাড়াও ১ জুলাই আদাবরের শেখেরটেক এলাকায় সজল (১৫) নামে এক টেইলার্স কর্মীকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে তার বন্ধুরা।৬ জানুয়ারি ২০১৭ শুক্রবার রাজধানীর উত্তরায় দুটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে খুন হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান।এ ঘটনার মাত্র ১২ দিনের মাথায় ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর তেজকুনিপাড়ায় ‘কে বড়,কে ছোট’ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে কয়েক কিশোরের হাতে খুন হয় আবদুল আজিজ নামে আরেক কিশোর।ঠিক ১০ দিন পরই ২৮ জানুয়ারি বরিশালে দশম শ্রেণীর ছাত্র হৃদয় গাজী নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে তারই সমবয়সী অপর একদল কিশোর।এভাবে একের পর এক কিশোরদের অপরাধ কর্মকাণ্ড বেপরোয়াভাবে বেড়েই চলছে।২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ও পরবর্তীতে কুপিয়ে হত্যা করে তাদেরই মেয়ে ঐশী।২০১৬ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর নতুন মডেলের মোটরসাইকেল না পেয়ে ফরিদপুরে বাবাকে হত্যা ও মা’কে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে এক কিশোর।দুটি ঘটনাই দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।গত কয়েক বছরে কিশোর কর্তৃক সংঘটিত কয়েকটি আলোচিত অপরাধের ঘটনা হচ্ছে,জুরাইনে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ হত্যা,আগারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল হক হত্যা, কদমতলীর বাবু,জনি ও হাসান হত্যা,পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল হক,মগবাজারের ট্রিপল মার্ডার,ভাসানটেকে নাসির এবং মিরপুরে ইমন হত্যা ইত্যাদি।
কিশোর অপরাধ নিয়ে গবেষণা কী বলছে : ২০১৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ‘বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতি’ এর একটি প্রকল্পের আওতায় কিশোর অপরাধ নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন।গবেষণায় দেখা যায়,সময়ের সাথে সাথে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। গবেষণায় ১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কিশোর অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে,১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় কিশোর অপরাধের মোট মামলা ছিল ৩,৫০১টি।কিন্তু পরবর্তী ১০ বছরে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত এ দশ বছরে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪,৮২টি।এদিকে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, কিশোর অপরাধীরা তাদের সাধারণ অপরাধের ধরণ পরিবর্তন করে ভয়ংকর ফৌজদারী অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে,এসবের মধ্যে খুন ও ধর্ষণই প্রধান।ওই গবেষণার তথ্যমতে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এ বছরে ৮২টি হত্যা মামলা এবং ৮৭টি নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ মামলা ছিল।কিন্তু পরবর্তী ২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ পরবর্তী ১০ বছরে এ মামলার সংখ্যা যথাক্রমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৮ ও ২২৪-এ!এছাড়া ২০০১ সালে কিশোর অপরাধের ৫১২ টি মামলার মধ্যে ১৩৮টি চুরি,১৪টি হত্যা ও ১৮টি নারী নির্যাতন মামলা হয়।পাঁচ বছর পর ২০০৬ সালে ৫২৮ টি মামলার মধ্যে নারী খুন ও নারী নির্যাতন মামলা বেড়ে হয় যথাক্রমে ১৫ ও ২২।গবেষণায় সর্বশেষ ২০১২ সালের তথ্যে দেখা যায়,কিশোর অপরাধের মামলা কমলেও খুন-ধর্ষণের মত ভয়ানক অপরাধ আরও বেড়ে গেছে।ওই বছরে ৪৮৫টি মামলার মধ্যে ১৭টি হত্যা ও ৩৮টি নারী নির্যাতন এবং ৮৫টি মামলা হয়। তবে ২০১২ সালে ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি।শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী,৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরর বয়সী ছেলে শিশু অপরাধে জড়ালে তাদেরকে বড়দের মতো কারাগারে পাঠিয়ে শাস্তি না দিয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় এবং তাদের মানসিকভাবে শোধন করার ব্যবস্থা করা হয়।এই দুটি কেন্দ্র থেকে সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে পাঠানো তথ্যে জানা গেছে,দুটি কেন্দ্রে মোট কিশোর অপররাধীর সংখ্য ৫৯৭ জন যাদের ১২০ জন হত্যা এবং ১৪২ জন নারী নির্যাতম মামলার আসামি।শতাংশের হিসাবে ২০ শতাংশ খুন এবং ২৪ শতাংশ নারী নির্যাতন মামলা আসামি। এসব কিশোরের বেশিরভাগের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।তেজগাঁও জোন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান,পুলিশ সর্বশেষ ২০১০ সালে পাড়া-মহল্লায় সক্রিয় কিশোর অপরাধীদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল।ওই তালিকায় ৫১৬ জনের নাম ছিল।তবে বর্তমানে যেসব কিশোর অপরাধ জগতে পা বাড়াচ্ছে তাদের আনুন্ঠানিক কোনো তালিকা পুলিশের কাছে নেই।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শেখ তৌহীদুল ইসলাম মনে করেন,কিশোর অপরাধীদের মধ্যে এখন তিনটি শ্রেণি আছে।এর মধ্যে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোরেরা দারিদ্র্যের কারণে,মফস্বল থেকে বড় শহরে আসা কিশোরেরা সমাজে টিকে থাকার জন্য এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে।পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল আলম প্রিয়.কমকে বলেন,দুর্বল পারিবারিক বন্ধন,নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, চরম ভোগবাদী চেতনার প্রসার,কুরুচিপূর্ণ ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির প্রতি আসক্তি,ক্ষুধা-দারিদ্র,মাদকাসক্তি ইত্যাদি সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।সবচেয়ে ভয়ংকর কথা হচ্ছে এসব কিশোর অপরাধীরাই এক সময় বড় অপরাধীর জন্ম দেয়।যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে।পরিবার ও সরকার প্রত্যেকেরই উচিত নিজের অবস্থান থেকে জরুরি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে এ প্রবণতা ঠেকানো,তা না হলে অপরাধপ্রবণ তরুণ সমাজ দেশের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠবে।সন্তানের অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠার পেছনে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন ও সন্তান প্রতিপালনের ভুল পদ্ধতিই মূল কারণ বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনইস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম।তিনি বলেন,শিশুকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে সন্তান প্রতিপালনে যে তিনটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে সে সম্পর্কে প্রায় সব মানুষই অজ্ঞ।ফলে সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের দুর্বল প্রকৃতির বন্ধনে শুরুতেই তৈরি হয় এক ধরনের প্রচ্ছন্ন দূরত্ব।এতে বাবা-মা সন্তানদের পারিপাশ্বিক অবস্থা সম্পর্কে যেমন খোঁজ রাখেন না, সন্তানরাও তাদের কর্মকাণ্ড গোপন রেখে চলেন।সমস্যার সূচনা হয় এখানেই।তথ্য প্রযুুক্তির অবাধ ব্যবহার,ভোগবাদী প্রবণতা বৃদ্ধিতে অর্থের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াও কিশোরদের বিপথগামী করে তোলে বলে মন্তব্য করেন ডা. তাজুল।তিনি বলেন,কিশোরেরা ভোগবাদী প্রবণতা ও ক্ষমতার চর্চার প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হয়। ক্ষমতা ও টাকাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে।ঠিক ওই সময়ে সমাজের অন্যান্য অপরাধীরা তাদের স্বার্থে কিশোরদেরকে ছায়া দিয়ে বড় অপরাধী করে তোলে।‘এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার ঘটনাগুলো কিশোদের অপরাধ প্রবণতায় উৎসাহিত করে তোলে। ফলস্বরূপ কিশোর অপরাধীদের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসে বড় বড় অপরাধী’,যোগ করেন তাজুল ইসলাম।
সূত্র : প্রিয় সংবাদ/রিমন
Post Views:
২৫১
|
|