|
বিশুদ্ধ পানির ভয়াবহ সংকট গোটা বরিশাল নগরী জুড়ে
এইচ আর হীরা : বিশুদ্ধ পানির ভয়াবহ সংকট গোটা বরিশাল নগরী জুড়ে। গভীর নলকূপে পর্যাপ্ত পানি না ওঠা এবং পানির ট্যাঙ্ক ও পাইপ লাইন পরিস্কার না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অভিজাত বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত টিউবওয়েল থেকে পানির চাহিদা মেটানো হলেও বিশেষ করে বর্ধিত ও বস্তি এলাকায় চলছে সুপেয় পানির হাহাকার। বরিশাল নগরীতে বিসিসি’র নিয়ন্ত্রনে যে কয়টি পানির ট্যাঙ্ক রয়েছে সেগুলো থেকে যে পরিমান পানি সরবরাহ করায় তাতে গ্রাহকদের চাহিদা পূরন হয়না। নগরীতে যতগুলো পানির ট্যাঙ্ক রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ১৯৭৮ সালে ২২ নং ওয়ার্ড কাজিপাড়া এলাকায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর দ্বারা নির্মিত পানির ট্যাংঙ্কটি । বর্তমানে ট্যঙ্কটির নিচের অংশ এবং আশপাশের পীলারগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ ব্যাপারে পানির ট্যাঙ্ক এর বাল্ব অপারেটর মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, পাম্পের দেখাশুনা ও পাম্প পরিচালনা করার জন্য আমার পরিবারসহ এখানে থাকি, কিন্তু বর্তমানে ট্যাঙ্কটির অবস্থা এমন নাজুক হয়ে পরেছে যে আমরা খুব জীবন ঝুঁকিতে রয়েছি। তিনি আরো বলেন, মাঝে মাঝেই ট্যাঙ্কির পেলেস্তা খসে নিচে পড়ে যায়, যদি সেগুলো কারোর মাথায় পরে তাহলে যেকোন একটা বড় দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। সূত্র বলছে, দীর্ঘ ১০ বছর পূর্বে পানির ট্যাঙ্কটি পরিষ্কার করা হয়েছিল এরপর আর কখনো পরিস্কার না করায় ট্যাঙ্কের ভিতর শ্যাওলা, ক্যাচো, জোক, পোকাসহ বিভিন্ন ধরনের কিট পতঙ্গ জন্ম নিচ্ছে। অন্যদিকে কিছু সংখ্যাক এলাকায় সরবরাহ লাইনে ত্রুটির কারণে পরিশোধিত পানি বাসার কলে আসার সময় নিয়ে আসে ময়লা আর দুর্গন্ধ। ওই পানি ফোটালেও দুর্গন্ধ দূর হয় না সব সময়। পাইপ লাইনের ওই পানি পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একই পানির ট্যাঙ্কের আরেক বাল্ব অপারেটর মোঃ গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমাদের এই পানির ট্যাঙ্ক থেকে নগরীর ২০, ২১, ২২, ২৩ এবং ২৮ নং ওয়ার্ডের গ্রাহকদের পানি সরবরাহ করে থাকি। এতো বড় এড়িয়ার জন্য মাত্র ২টি পাম্প রয়েছে। অনেক সময় দুইটি পাম্পের যেকোনো একটির যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে জনগনের খুব ভোগান্তিতে পড়তে হয় তখন আমরা বিপাকে পড়ে যাই। বিসিসি কর্তৃপক্ষ যদি আরো একটি পাম্পের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে গ্রাহকদের পানির চাহিদা পূরণে আর কোনো ত্রুটি থাকতো না। বিসিসি সূত্র জানায়, ৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের (বিসিসি) আওতায় প্রায় সাত লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু বিসিসি’র পানির গ্রাহক আছেন ২২ হাজার। বাকি গ্রাহকরা ব্যক্তিগত টিউবওয়েলসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। প্রতিদিন এ বিপুলসংখ্যক মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা সাড়ে পাঁচ কোটি লিটার। এর বিপরীতে বিসিসি কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে পারছে মাত্র ২ কোটি ৯০ লাখ লিটার। সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে বিসিসি’র নিবন্ধিত পানির গ্রাহক আছে ২২ হাজার। বাকিরা ব্যক্তিগত টিউবওয়েলসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকে। সরবরাহ সক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় সিটি করপোরেশন নতুন করে গ্রাহক নিচ্ছে না। ২২নং ওয়ার্ড জিয়া সড়ক এলাকার বাসিন্দা রাহিমা বেগম অভিযোগ করেন, সিটি কর্পোরেশনের সরবরাহ করা পানির গতি কম থাকায় রিজার্ভ ট্যাংকে পানি আসে না। কখনো কখনো সামান্য একটু পানি এলেও তাতে ঠিকমতো রান্না ও গোসল করা সম্ভব হয় না। নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের শিকদার পাড়া এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, সিটি কর্পোরেশনের পানির লাইনে আগে দিনে অন্ততপক্ষে দুইবার কিছু সময়ের জন্য আসত। কিন্তু বর্তমানে কখন পানি আসে আর কখন যায় কিছুই বলতে পারি না। এখন যাও একটু পানি পাই সেইটা দিয়ে গোসল, রান্না, কাপড় ধোয়াসহ অন্য কাজ করা যায় না। ২২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিছুর রহমান দুলাল বলেন, আমার ওয়ার্ডের প্রায় এক হাজার পরিবারের মধ্যে অর্ধেকেরই পানির ব্যবস্থা নেই। অনেকে গভীর নলকূপ বসিয়ে চাহিদা পূরণ করছেন। রাস্তায় যে (স্ট্রিক হেডেন লাইন) কল বসানো আছে সেগুলোও বন্ধ হয়ে আছে। তিনি আরো বলেন, কাজিপাড়ায় যে পানির ট্যাঙ্কটি রয়েছে সেইটার বর্তমানে করুণ অবস্থা। এ বিষয়ে আমি এবং ট্যাঙ্কের দায়ীত্বরত কর্মকর্তারা মেয়র মহাদয়ের কাছে বলার পরে তিনি নিজে এসে পরিদর্শন করে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন। নগর ভবনের পানি সরবরাহ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ লোকাল ফান্ড দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সামান্য টাকায় পুরো নগরীতে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন সরকারের আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়া। বর্তমানে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সিটি কর্পোরেশনের তিনটি পাম্পও বন্ধ হয়ে গেছে। এ সব এলাকায় নতুন নলকূপ বসাতে গিয়ে পানির স্তর পেতে বহু গভীরে যেতে হচ্ছে। নলকূপ বসানোর কাজে নিয়জিত ঠিকাদার জাকির হোসেন জানান, ৩/৪ বছর আগেও ৮’শ থেকে ৯’শ ফুট গভীরে গেলেই সুপেয় পানি পাওয়া যেত। এখন এক হাজার ফুট পর্যন্ত গভীরে যেতে হয় সুপেয় পানি পেতে। ২০ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ রাজ্জাক হোসেন বলেন, সাপ্লাই পানিতে ময়লা আসার কারনে মাঝে মাঝে “মসজিদে নামায পড়তে যেতে পারি না। বাসায় পানি না থাকলে মসজিদে থাকবে কী করে? গতকাল ভোরে কিছুক্ষন পানি এসেছে, তাও ময়লা পানি। এ পানি কি খাওয়া যায়।” এই অবস্থায় ভাড়াটিয়াদের গালাগাল শুনতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা তো টাকা দিয়ে থাকে। পানি না পেলে ভাড়া থাকবে কেন?” নগরবাসীর জন্য ‘বিশুদ্ধ পানি’ সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র কর্তৃপক্ষ বিসিসি’র পানি সরবরাহ বিভাগ। কিন্তু ময়লা, দুর্গন্ধ এবং রোগজীবাণুর শঙ্কায় বিসিসি’র পানি সরাসরি কল থেকে পান করার চল উঠে গেছে অনেক আগেই। এর বদলে বাসাবাড়িতে জ্বালানি পুড়িয়ে পানি ফুটিয়ে ও ফিল্টার করে এবং অফিস আদালতে বোতলজাত পানি কিনে বরিশালবাসীর জীবন চলছে। এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করর্পোশনের পানি শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মো: হুমায়ুন কবির বলেন, “আসলে আমি এই বিভাগে যোগদান করেছি দেড়/দুই মাস হয়েছে, আমার জানা মতে এটি নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। আর আমরা যে এলাকায় অভিযোগ পাই সেখানেই পরিষ্কার করে থাকি।” পানির ট্যাঙ্কগুলোর যদি কোন সমস্যা দেখা যায় তাহলে তা দ্রুত সমাধান করা হবেও বলে জানান বিসিসি’র এই কর্মকর্তা।
Post Views:
১৭৬
|
|