|
যা এখন শুধুই রুপকথার কল্পকাহিণী বা রুপকথা
বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সে-ই ‘ধানের গোলা’
সুব্রত বিশ্বাস : আগের দিনে গেরস্থ বলতে মাঠ ভরা সোনালী ফসলের ক্ষেত, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর কৃষকের গোলা ভরা ধান-কেই বুঝাতো।এখন এসবই প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে।কালের বির্বতনে হারিয়ে গেছে গেরস্থের ঐতিহ্যবাহী সে-ই ‘ধানের গোলা’।হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিক্ষেত ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী গোলা।মাঠের পর মাঠ ধান ক্ষেত এখন চোখে পড়লেও নেই ধান মজুদ রাখার বাঁশ, বেত ও কাঁদা দিয়ে তৈরী গোলাঘর।অথচ একটি সময় ছিল সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার ক’টি ধানের গোলা আছে তার উপর।কন্যা পাত্রস্থ করতেও বর পক্ষের বাড়ী, ধানের গোলার খবর আগে নিতো কনে পক্ষের লোকজন, যা এখন শুধুই রুপকথার কল্পকাহিণীর মতো।গ্রাম অঞ্চলে বাড়ীতে বাড়ীতে বাঁশ দিয়ে গোল আকৃতির তৈরী করা ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে।গোলার মাথায় থাকত টিনের তৈরী মিশরের পিরামিড আকৃতির টাওয়ার, যা অনেক দূর থেকেই দেখা যেত।গ্রাম অঞ্চলে বাড়ীতে বাড়ীতে বাঁশ, বাঁশের বাতা ও কাঞ্চি দিয়ে প্রথমে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরী কর হতো।কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গ অথবা আয়তক্ষেত্র আকারে গোলা তৈরী করে তার গায়ে ভিতরে ও বাহিরে বেশ পুরু মাটির আস্তরণ লাগানো হতো।এর মুখ বা প্রবেশ পথ রাখা হতো বেশ উপরে।ধান বাহির করার জন্য নীচে বিশেষ দরজা রাখতেন, যেন চোর-ডাকাতরা কোন কিছু চুরি করতে না পারে। ধানের গোলা তাই বসানো হতো অনেক উঁচুতে।গোলার মাথায় থাকত বাঁশ ও খড়ের তৈরী বা টিনের তৈরী ছাউনি, যা দেখা যেত অনেক দূর থেকে।গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল।এখন আর দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসা গোলা নির্মাণ শ্রমিকদের এখন দেখা মেলাই ভার।এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় এখন তারা নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।অথচ গোলা নির্মাণের সময় তাদের সংবাদ দিয়ে আনতে হতো।তারা আগে এসে নানা পরামর্শ করে মাটি পর্যবেক্ষণ, জায়গা নির্ধারণ করার পর কাজে হাত দিত।এক একটি গোলা নির্মাণ খরচ হতো তার আকার ও শ্রমিক কতজন লাগবে তার উপর।তবে তখনকার দিনে এক একটা গোলা নির্মাণ খরচ পড়ত সে-ই সময়কার ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।বর্ষার পনি আর ইঁদুর তা স্পর্শ করতে পারত না।মই বেয়ে গোলায় উঠে তাতে ফসল রাখতে হতো।আর এই সুদৃশ্য গোলা-ই ছিল সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারের ঐতিহ্য।সেই সময় ভাদ্র মাসে কাঁদা পানিতে ধান শুকাতে না পেরে কৃষকরা ভেজা আউশ ধান রেখে দিত গোলা ভর্তি করে।গোলায় শুকনো ভেজা ধানের চাল হতো শক্ত।কিন্তু সম্প্রতি রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কালের লাঙ্গল যেন উল্টে-পাল্টে দিয়েছে গ্রাম অঞ্চলের চালচিত্র।গোলায় তোলার মত সময় আর তাদের থাকে না।গোলার পরিবর্তে কৃষকরা ধান রাখা শুরু করে বাঁশের তৈরী ক্ষুদ্রাকৃতি ডোলায়।ধান আবাদে ও উপকরন কিনতেই এখন কৃষকের লাগে বিস্তর টাকা।কৃষকের ধানের গোলা ও ডোলা এখন শহরের বিত্তশালীদের গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে।কৃষকের ধান চলে যাচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী ফড়িয়া ও আড়ত ব্যবসায়ীর দখলে।ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে পাকা ইমারত গুদাম ঘরে মজুদ করে রাখা হচ্ছে হাজার হাজার টন ধান চাল।অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বস্তা ও বেরেল ভর্তি করে রাখছে আউশ, আমন ও বোরো মৌসমে উৎপাদিত ধান চাল।আমার বাবার কাছে শুনেছি, তাদের পূর্ব পুরুষদের ঘোলা ভরা ধান-চালে চলতো ১০/১৫-টি গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকা আর তাদের সংসার।গোলাভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছই ছিল জমিদারি প্রথা ও উচ্চ চাষী পরিবারের ঐতিহ্য।ছিলো কাঠা’র (মাটির তৈরী) দ্বিতল বাড়ী।বড় বাড়ী লোক নামেই সবাই চিনতো সে-ই বাড়ীর লোকজনদের।পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া গোরাঘর ধান চাল উঠানো-নামানো হতো ঘোড়া গাড়ী আর গরুর গাড়ীতে করে, যা এখন সবই কল্পকাহিনী বা কল্পকথা। একটা গোলা ঘরে ঘোড়া বা গরু গাড়ী যে প্রবেশ করতে পারে, তা বিশ্বাস করতে নারাজ বর্তমান প্রজন্ম।তবে গ্রাম এলাকায এখনো বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী গোলা রক্ষায় ধনী শ্রেণীর কৃষকরা বাঁশের তৈরী গোলা আজও ধরে রেখেছেন।বাস্তবতা বড়ই কঠিন, বড়ই নিষ্ঠুর।আগামী প্রজন্মের কাছে গোলা ঘর এখন শুধুই স্মৃতি।আধুনিক গুদাম ঘর ধান-চাল রাখার জায়গা দখল করে নিয়েছে।ফলে গোলা ঘরের সে-ই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
Post Views:
৪,৯৬৩
|
|