|
‘অন্যায়কারীর পক্ষে থাকি না, পুলিশ অন্যায় করলে তাকে সাপোর্ট করি না’- পুলিশ (বিএমপি) কমিশনার এস এম রুহুল আমিন
বরিশাল নগরের অপরাধচিত্র বদলানোর গল্প
আলম রায়হান : একসময় বরিশাল মহানগর ছিল অপরাধীদের অভয়ারণ্য।চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারীব্যবসাসহ নানা অপরাধের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল নগরবাসী।মহানগর পুলিশ বিভাগ প্রতিষ্ঠার পরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।বরং অপরাধীদের সহযোগী হিসেবে অতীতে পুলিশের কোনো কোনো বড় কর্তার নাম এসেছে।এ সুযোগে অনেক পুলিশ সদস্য নিজেদের জড়িয়েছেন মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে।সব মিলিয়ে বরিশালের নগরবাসীর বসবাস ছিল এক অসহায় নিয়তির ভেতর।কিন্তু হঠাৎ মেঘ কেটে যেতে থাকে এস এম রুহুল আমিন বরিশালের পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগ দেয়ার পর।কী এমন জাদুতে বদলাল বরিশালের অপরাধচিত্র? কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে সেটিই জানার চেষ্টা করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আলম রায়হান।না, কোনো জাদু নয়, বরিশাল মহানগর পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার এস এম রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেলে, দায়িত্ব পালনে সচেতনতা আর আইন প্রয়োগের সরল অনুশীলনই ভূমিকা রেখেছে বরিশাল মহানগরীর অপরাধপ্রবণতা কমাতে।বিএমপি কমিশনার বলেন, ‘বরাবরই আমি আইন প্রয়োগের অনুশীলন করি।চাপের কাছে নতি স্বীকার করি না। অন্যায়কারীর পক্ষে থাকি না।পুলিশ অন্যায় করলে তাকে সাপোর্ট করি না।’বিএমপির দায়িত্ব নেয়ার পর এই উচ্চ নৈতিকতার পাশাপাশি সেখানকার অপরাধসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে ‘হোম ওয়ার্ক’ করেন এস এম রুহুল আমিন।বেশ কয়েক দিন তিনি পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন।তার ভাষ্য, ‘আমি দেখলাম, অপরাধী ধরা পড়লে প্রায় ক্ষেত্রেই থানায় জোরালো তদবির আসে।কখনো কখনো আসামি ছাড়াতে তদবিরকারীর প্রতিনিধি থানায় এসে দাপট দেখায়।কোনো ক্ষেত্রে তদবির থাকার দোহাই দিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অপরাধী ছেড়া দেয়ার ।’কী ব্যবস্থা নিলেন এসবের বিরুদ্ধে? জানতে চাই।কমিশনার বলেন, ‘এ অবস্থায় আমি বলে দিলাম, তদবির চলবে না! কেউ তদবির করলে তার বিরুদ্ধে জিডি করার নির্দেশ দিলাম ওসিদের।আর তদবিরকারী থানা থেকে যেতে না চাইলে তাকেও আসামির সঙ্গে হাজতে ঢুকানোর নির্দেশ দিলাম।’‘এতে বেশ কাজ দিয়েছে।’বলেন কমিশনার, ‘অপরাধীদের কাছে ম্যাসেজ ক্লিয়ার, ধরা পড়লে পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার আর সুযোগ নেই।’কেবল অপরাধীদের ব্যাপারে কঠোর হয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে? না!অপরাধীদের ছাড়া পাওয়ার পথ বন্ধ করার পাশাপাশি পুলিশের বিষয়েও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন কমিশনার।তার ভাষ্য, ‘পেশাদার অপরাধীর অপকর্মের চেয়ে বহুগুণ বড় অন্যায় হলো পুলিশের কোনো সদস্য যদি অপরাধ করে।এটি তখন হয়ে যায় ডাবল অপরাধ।অপরাধে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্য প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী; পাশাপাশি সে তার পেশার সঙ্গে বেইমানি করার জন্য আরো বড় অপরাধী।এ বিবেচনাতেই আমি অপরাধ দমনের প্রথম কাজটি করেছি আমার বিভাগ থেকে।ফলে বেশ ভালো ফল পাওয়া গেছে।’তবে অপরাধ কখনো নির্মূল করা যায় না, নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, বলেন কমিশনার।মাদকের আগ্রাসন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে এস এম রুহুল আমিন বলেন, সামাজিক এই ব্যাধির বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদসহ সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।বরিশাল মহানগরে অন্যান্য অপরাধের মতো অবৈধ মাদক ব্যবসাও ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বলে দাবি পুলিশ কমিশনারের,‘কেবল মাদক ক্রেতা আর ছোট ব্যবসায়ী নয়, গডফাদারও আটক করা হয়েছে। মাদকের আগ্রাসন মোকাবিলায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এখন আর মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে রাজনৈতিক কোনো তদবির আসে না।’দেশের ভেতরে মাদক নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে কড়া নজরদারি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন পুলিশ কমিশনার রুহুল আমিন। তিনি বলেন,‘কোনো মাদকই আমাদের দেশে উৎপাদিত হয় না, আসে সীমান্তের ওপার থেকে।সীমান্ত দিয়ে মাদকের অনুপ্রবেশ রোধে আরো বেশি নজরদারির ব্যবস্থা নিলে তা দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে যায়।’বিভিন্ন থানার মামলাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বরিশালের পুলিশ কমিশনার বলেন, মামলার পরিসংখ্যান সব সময় অপরাধের প্রকৃত চিত্র দেয় না।যেমন ধরুন, কোনো ওসি নানা কৌশলে মামলা কম নেন।অন্য ওসি মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে উদার।তা হলে প্রথম ওসির চেয়ে দ্বিতীয় ওসির মেয়াদে বোধগম্য কারণেই মামলার সংখ্যা বেশি হবে।তার অর্থ এই নয় অপরাধ আগের চেয়ে বেড়েছে।আসলে অপরাধের মাত্রা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের পাশাপাশি পাবলিক পারসেপশনও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।এ ছাড়া আরো অনেক বিবেচ্য বিষয় আছে।তবে সর্বোপরি অপরাধপ্রবণতা রোধে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভূমিকার ওপরও জোর দেন বরিশালের পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন।বলেন,‘সমাজ-প্রশাসন-দেশ এগিয়ে নিতে বৈরিতা নয়; গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ভালো লোকের ঐক্যের ওপর।আমরা এটাই করার চেষ্টা করছি।’
Post Views:
৭৯
|
|