|
বিভিন্ন দেশে রফতানির মাধ্যমে আর কচুরিপানার কাগজে আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা
বরিশালে বড় দিনের শান্তা ক্লজ, বাহারী উপহার তৈরীতে-দুই হাজার নারী
শামীম আহমেদ, অতিথি প্রতিবেদক : বড় দিন উপলক্ষে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রায় দুই হাজার দুঃস্থ ও বিধবা নারীর শ্রমে কচুরিপানার বিশেষ কাগজ দিয়ে তৈরী শান্তা ক্লজ, বাহারী উপহার ও খেলনা সামগ্রী বিদেশে রপ্তানী করে সুনামের সাথে অর্জন করছে বৈদেশিক মুদ্রা। পরিত্যক্ত ডোবা ও পুকুরের কচুরিপানা দিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত কাগজ, জুট পেপার, কটন পেপার, সিল পেপার, শনপাট, ওয়াটার রাইজিং দিয়ে তৈরী করা হয়েছে যীশু খ্রিষ্ঠের জন্মদিন উপলক্ষে দৃষ্টিনন্দন বড়দিনের শান্তা ক্লজ, কিসমাস ষ্টার, ষ্টার গারলাট, কিসমাস কার্ড, কিসমাস অর্নামেন্ট, ফ্লয়ার গারলাট, ট্রি সাজানোর পন্য, ক্রিসমাস ট্রি, গীর্জা ও বাড়ি সাজানোর পন্যসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপহার সামগ্রী। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রকৃতি’র উদ্যোগে আগৈলঝাড়া উপজেলার পাঁচটি কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার দুঃস্থ ও বিধবা নারী কর্মরত রয়েছেন। আগৈলঝাড়া উপজেলার পাঁচটি কেন্দ্রের মাধ্যমে শৌখিন এসব খেলনা ও উপহার সামগ্রী রপ্তানী করা হচ্ছে জাপান, অস্টেলিয়া, সুইডেন, ইতালী, জার্মান, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এখানকার তৈরি করা কচুরিপানার ওইসব শৌখিন উপহার সামগ্রী দেশ ও বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ফলে বিধবা ও দুঃস্থ নারীরা খুঁজে পেয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজে কর্মরত ওই গ্রামের বাসিন্দা মনি বালা (৪৮) জানান, কচুরিপানা আর বড়দিন তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মনিবালা কচুরিপানার কাগজ দিয়ে তৈরি করা বড় দিনের শান্তা ক্লজসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী তৈরির সু-নিপুন কারিগরদের একজন। মনি বালার মতো ওই এলাকার অসংখ্য অসহায় ও দুঃস্থ নারীরা আগৈলঝাড়ার পাঁচটি কেন্দ্রে কাজ করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। মনি বালা বলেন, অভাবের সংসারে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচেছিলাম। কাজের মাধ্যমে আজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ ভালোই রয়েছি। মনি বালার আরেক সহকর্মী বিধবা বীনা হালদার (৫০) ও বিধবা শিউলী বেগম (৪৭) বলেন, আমরা যেসব জিনিস তৈরি করছি, সেগুলো দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দেশ ও বিদেশের খ্রীষ্টিয় সম্প্রদায়ের লোকজনে শুভ বড় দিন পালন করে আসছেন। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিক তাদের উৎপাদিত কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে চার থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা আয় করছেন। জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার পাপড়ি মন্ডল বলেন, বর্তমানে প্রকল্পের পাঁচটি কেন্দ্রের প্রায় দুই হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এদেরমধ্যে অধিকাংশরাই হচ্ছেন স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা কিংবা অসহায় ও দুঃস্থ পরিবারের। তিনি আরও বলেন, এবছর দেশ-বিদেশে এখানকার নারীদের কচুরিপানার কাগজে তৈরি শান্তা ক্লজসহ বড়দিনের অন্যান্য শৌখিন পন্য দেশ ও বিদেশের বাজারে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। প্রোডাক্ট ডিজাইনার খোকন সমদ্দার বলেন, উপজেলার জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজ, কালুরপাড়ের বির্বতন, বড়মগরার কেয়া পাম হ্যান্ডিক্রাফ্টস, নগরবাড়ির চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ও বাগধা এন্টারপ্রাইজে প্রতিবছরই নতুন নতুন গিফ্ট আইটেমের কাজ করা হয়। এখানে চার হাজারের উপর আইটেম তৈরী করা হয়ে থাকে। বিবর্তন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৯৮৪ সালে কচুরিপানাকে ঘিরে এমসিসি (মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি) আওতায় এলাকায় গড়ে ওঠে জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় এলাকার অসহায় নারীরা শুধু ডোবা ও মজাপুকুর থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে কচুরিপানার সাথে পাট, পরিত্যক্ত কাগজ ও সিল্ক কাপড় দিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়। এরপর তাতে রং দিয়ে রোদে শুকানোর পর তৈরি হয় কাগজ। এভাবে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে তিন হাজার পিস কচুরিপানার কাগজ। সেই কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয় হস্তজাত উপহার সামগ্রী। ওই উপহার সামগ্রীতে বিভিন্ন ধরনের কাঁচা ফুলও ব্যবহার করা হয়। সূত্রে আরও জানা গেছে, অল্প সময়ের মধ্যে অসহায় নারীদের হাতে তৈরি পণ্য বিদেশের বাজার দখল করে নেয়। একইবছর উপজেলার বাগধা এলাকায় বাগধা এন্টারপ্রাইজ নামে আরো একটি প্রকল্প চালু করা হয়। এ দুটি প্রকল্পের সাফল্যের পর ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠে কেয়াপাম হ্যান্ডিক্রাফট নামের আরো একটি প্রকল্প। এরপর ১৯৯৩ সালে আগৈলঝাড়ায় বিবর্তন নামের আরো একটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। কচুরিপানার কাগজ দিয়ে তৈরি উপহার সামগ্রী পাঠানো হচ্ছে-কানাডা, ডেনমার্ক, ইতালী, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। প্রতিবছরই ওইসব দেশে এ উপহার সামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে বড়দিনের উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এর চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সংস্থার মাধ্যমে শৌখিন এসব খেলনা ও উপহার সামগ্রী ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রফতানির মাধ্যমে আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। দুঃস্থ নারীদের তৈরি করা কচুরিপানার শৌখিন উপহার সামগ্রী সর্বত্র প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রকৃতি বাংলাদেশ’র মাদার প্রকল্প এমসিসি আমেরিকা’র কান্ট্রি প্রতিনিধি মি: জর্জ জানান, ১৯৮৭ সালে আগৈলঝাড়ায় কেয়াপাম হ্যান্ডিক্রাফট্স মাত্র সাতজন নারী কর্মী নিয়ে ছয় লাখ ডলার মূল্যের রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করে। বর্তমানে এখানকার হস্তজাত শিল্প এখন ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ২০ লাখেরও বেশী মার্কিন ডলার আয় করছে।
Post Views:
১৪৪
|
|