মুক্তখবর ডেস্ক রিপোর্ট : এবার নতুন একটি খেল দেখালো বরিশাল মেট্রোপলিটন বন্দর থানা পুলিশ। বিপুল চিংড়ি রেণুপোনাসহ পাচারকারীদের আটক নিয়ে দেখতে হয়েছে থানা সংশ্লিষ্টদের বহু নাটকীয়তা। গভীর রাতে সাংবাদিকদের কৌশলতায় আটক পাচারকারীদের রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। এমনকি সাংবাদিক তাড়িয়ে পাচারকারীদের পথ নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল। থানা পুলিশের এই মিশন সফল না হলেও কৌশলে আটক পাচারকারীদের নামমাত্র জরিমানা দিয়ে আইনের ফাঁক থেকে বেড়িয়ে আসতে সুযোগ করা দেয়া হয়েছে। অবশ্য সেই সুযোগ কাজেও লাগিয়েছে জাতীয় সম্পদ ধ্বংসকারী চক্রটি। শেষাবধি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ১৪ পাচারকারীকে মাত্র ২৮ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি আটক ৩ লাখের বেশি রেণুপোনা অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু বিষ্ময়ের বিষয়, বরিশাল সদর উপজেলার নেহালগঞ্জ ফেরিঘাট থেকে এই ঘটনায় একটি ট্রাক, একটি মোটরসাইকেল ও ট্রলারও জব্দ করা হয়েছিল। অথচ নামমাত্র জরিমানার বদৌলতে পাচারের পুরো সরঞ্জাম অর্থাৎ ট্রাক, নৌকা ও মোটরসাইকেল ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রভাবিত হলো কিনা? যদিও অভিযোগ রয়েছে রেণুপোনা সংশ্লিষ্ট বরিশাল মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাও এই ঘটনায় ম্যানেজ হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে বিগত সময়ে একই ধরনের অভিযানে আটকদের জরিমানার পাশাপাশি জব্দ ট্রাক বা নৌকা নেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের দারস্থ হওয়া জরুরি। কিন্তু এবার বিপরীত চিত্র কেন সেই বিষয়টি খোদ সাংবাদিকদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে এই পাচারকারী চক্রের সাথে মৎস্য বিভাগ বা পুলিশ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তা অনেক আগেই শোনা যাচ্ছিল। অবশ্য গভীর রাতে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে পাচারকারীদের নির্দিষ্ট এলাকা অতিক্রমে সহযোগিতার বিষয়টিও ঘটনাচক্রে প্রকাশ পেয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে এই সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে প্রতিরাতে রেণু পাচারকারী চক্রের মূলহোতা টুলু ও হারুন মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে থাকেন। যে বিষয়টি আটকের পর অনেকটা খোলাখুলিভাবে হারুন সাংবাদিকদের অবহিত করেন। মঙ্গলবার ভোর রাতে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের নানামুখি প্রশ্নে বিষয়টি ফাঁস করে দিতে হারুন এক ধরনের বাধ্য হয়ে জানিয়েছেন ওসি কত নেন প্রতি রাতে। তাছাড়া গভীর রাতে তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বন্দর থানা পুলিশের কতিপয় এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তাকেও কত টাকা দিয়ে থাকেন। হারুনের ভাষ্য অনুযায়ি ৫ লাখ টাকার ওপরে রেণুপোনা পাচার হলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি গোলাম মোস্তফা হায়দার ১ লাখ টাকা উৎকোচ নেন। পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা বা রাস্তা পরিস্কার এমন সংকেতের জন্য রাতে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দিতে হয় ৫ হাজার টাকা করে। সবকিছু মিলিয়ে বলা চলে পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করছে পাচারকারী চক্র। যদিও এই অভিযোগটি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট থানার ওসি গোলাম মোস্তফা হায়দার। তার ভাষ্য, পাচার সম্পর্কিত কোন তথ্য-উপাত্ত নেই। খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সদর উপজেলার নেহালগঞ্জ ফেরিঘাট থেকে প্রতিরাতে পুলিশের সহযোগিতায় রেণুপোনা পাচার হচ্ছে। মুলত এমন সংবাদের ভিত্তিতেই বরিশালের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মঙ্গলবার রাতে সেখানে অবস্থান নেয়। এমনকি একপর্যায়ে রেণুপোনা ফেরিঘাটে ট্রাকে তোলার সাথে সাথে পাচারকারীদের ছবি ক্যামেরাবন্দি করা হয়। ওই সময় পাচারকারী চক্রের অন্যতম হারুন সাংবাদিকদের ম্যানেজে অর্থ সমঝোতার প্রস্তাব দেন। সেই সাথে এই চক্রের সাথে জড়িত টুলুও মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের প্রস্তাব দেন। কিন্তু জাতীয় সম্পদ ধ্বংসকারীদের সাথে আপোষ বা অর্থ লেনদেনে মিডিয়ার সুযোগ কোথায় এমন প্রশ্ন রাখলে তাদের সাথে দূরত্ব বাড়ে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি বেগতিক ভাবনায় পুলিশ ডেকে সাংবাদিক তাড়াতে চক্রটি উদ্যোগ নেয়। যার দরুণ ওই থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক (এসআই) মইনুল ভোররাত ৪ টায় এসে সাংবাদিকদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। অবশ্য সাংবাদিকরাও তাদের অবস্থান এবং পাচারের বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্তু পুলিশের এই কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যেন অগ্রসর হচ্ছিল না। তবে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় বিষয়টি থানা প্রধান অর্থাৎ ওসির সাথে মুঠোফোনে আলাপচারিতা করেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিকদের অবহিত করেন এই বিষয়ে সামনে আগাবার সুযোগ নেই। অপেক্ষা করতে হবে সিনিয়র কর্মকর্তা না আসা পর্যন্ত। অবশ্য শেষাবধি এমনই ঘটনা ঘটল। রাত সাড়ে ৪ টার দিকে মাহেন্দ্রা গাড়ি নিয়ে আসলেন আরেক কর্মকর্তা। কিন্তু তিনিও জানালেন আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই আসছেন বড় স্যারে। তবে সেই বড় স্যারের আসার আগে পুলিশের সাথে পাচারকারীদের যে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক সেই বিষয়টি তাদের আচারণে প্রকাশ পেয়ে যায়। পরিশেষে আসলেন বড় স্যার অর্থাৎ ওই থানারই এসআই সবুর। কিন্তু তিনি যা শোনালেন তাতে রীতিমত হকচকিয়ে ওঠার জোগার। আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই কর্মকর্তা বললেন রেণুপোনা পাচার কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। সুতরাং পুলিশ পদক্ষেপ রাখবে কেন প্রশ্ন রেখে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন দেশের সম্পদ দেশেই থাকছে। যদিও সাংবাদিকদের নানামুখি প্রশ্নে একপর্যায়ে তিনি এমন বেফাঁস মন্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়েছেন। পাচারকারীদের আটকে পুলিশের এই নাটকীয়তা কেন তা আর সাংবাদিকদের বোঝার অপেক্ষা রাখে না। যে কারণে সাবির্ক পরিস্থিতিতে আটক পাচারকারীদের পুলিশ রক্ষা করতে চাইছে এই বিষয়টি অনুমানে নিয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হয় সাংবাদিকরা। একপর্যায়ে পুলিশের এই নাটকীয়তার বিষয়টি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র সহকারি কমিশনার (এসি ডিবি) নাসিরউদ্দিন মল্লিককে অবহিত করা হয়। মুলত তাকে অবহিত করার পরপরই একধরণের বাধ্য হয়ে পাচারকারীদের আটক করতে পদক্ষেপ রাখে পুলিশ। কিন্তু পুলিশের এই পদক্ষেপের আগেই বেশ কয়েকজন কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ট্রাকভর্তি রেণুপোনাসহ মাত্র ১৪ জনকে আটক দেখানো হয়। কিন্তু এখানেও হয়েছে নাটকীয়তা। ট্রাক, মোটরসাইকেল বা নৌকা জব্দ না দেখিয়ে পাচারকারীদের মাত্র ২৮ হাজার টাকা জরিমানায় মুক্তি দেওয়া হয়। অথচ একই ধরণের একটি অভিযানে মাসখানেক আগে র্যাবের হাতে আটক ট্রাকটি জব্দ দেখানো হয়েছিল। বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর ওই আদালত পরিচালনা করেছিলেন। যদিও এইবারও তিনিই আদালত পরিচালনা করেন। তাহলে দুধরণের রায় কেন এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সচেতন মহলে। এক্ষেত্রে নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের ভাষ্য হচ্ছে পুলিশ আটকের তালিকায় ট্রাক বা কোন সরঞ্জাম রাখেনি। যে কারণে আটককারীদের জরিমানার আওতায় এনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া উপ-পরিদর্শক এসাআই আব্দুল মালেক বলছেন- ইউএনও কেন বা কি কারণে ট্রাক জব্দ করলেন না সেই বিষয়টি তিনি অবগত নন। যদিও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে ফেরিঘাট থেকে পাচারকারীদের নিয়ে যাওয়ার পরপরই এসআই মালেকের সাথে সেখানে রফাদফা হয় ওসির নির্দেশে। মুলত এরপরেই পাচারকারীদের মালামাল রক্ষায় বন্দর থানা পুলিশ কৌশলী পদক্ষেপ রাখে। এমতবস্থায় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমানের অভিব্যক্তি হচ্ছে- এই পাচার সম্পর্কে তিনি অবগত নন। এমনকি থানা পুলিশ তাকে কখনও অবহিতও করেনি। তবে এই ঘটনায় ওসি বা থানা পুলিশের কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।