|
শারীরিক অসুস্থতা তার বর্ণাঢ্য জীবনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে, ছেড়ে যেতে হয়েছে এ পৃথিবীকে
বরিশালের প্রবীণ সাংবাদিক মিন্টু বসু’র পরলোক গমন
শামীম আহমেদ, অতিথি প্রতিবেদক : বরিশালের প্রবীণ সাংবাদিক,মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মিন্টু বসুর সৎকার কাজ সম্পূর্ন করা হয়েছে নগরীর কাউনিয়া মড়কখোলা শ্মশানে।আজ (০৪-১০-১৭) দুপুরে এ মিন্টু বসুর সৎকার কাজ সম্পূর্ন করেন তার নিকটতম আত্বীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব।এর পূর্বে মিন্টু বসুর মরদেহ দীর্ঘ দিনের সংগঠন খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সামনে আনা হলে তাকে শেষ বারের মত শ্রদ্ধা জানান সংগঠনের সদস্যরা।এরপর তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় সাংবাদিক জগতের সংগঠন শহীদ আঃ রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেস ক্লাব।এসময় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও ক্লাবের সদস্যরা মিন্টুর বসুর মরদেহের কফিনে ফুলের শ্রদ্ধা জানানো হয়।পরে মিন্টু বসুর মরদেহ মুক্তিযুদ্ধা সংসদ হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে সেখানে শেষ বারের মত সকল সংগঠন ও শুভাকাঙ্খিরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।মঙ্গলবার রাত সোয়া ১০টায় তিনি বরিশাল নগরীর শীতলাখোলা রোডের নিজ বাসায় বার্ধ্যক্যজনিত কারণে হঠাৎ করে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে হাসাপাতলে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।এছাড়া তিনি স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।বর্তমানে শ্রী মিন্টু বসুর স্ত্রী এবং মেয়ে ভারতের আসামে রয়েছেন।তারা তার সৎকার কার্য করতে বলেছেন।
মিন্টু বসুঃ বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী মিন্টু বসু একাধারে সাংবাদিক,লেখক,নাট্যকার,ঔপন্যাসিক,অভিনেতা ও সংগঠক ছিলেন।গুণি এ মানুষটি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বৈচন্ডি গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন।পিতার নাম নরেন্দ্রনাথ বসু ও মাতা শৈলবালা বসু।বাবা-মায়ের ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়ে যেমন এই সমাজকে আলোকিত করেছেন তেমনি নিজেকেও সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।স্বাধীনতা পূর্বকালে মিন্টু বসু ছিলেন ‘বরিশাল যুবসংঘ’র নেতৃস্থানীয়কর্মী।প্রথিতযশা সাংবাদিক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত মিন্টু বসু।সুদীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সংবাদপত্র ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকা থেকেই মিন্টু বসুর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়েছিল।প্রকৃতপক্ষে মিন্টু বসুর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের রনাঙ্গণে।‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকা ছিল রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপত্র।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের কোলকাতায় অবস্থানকালে মিন্টু বসু ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’র বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’এ দীর্ঘদিন বার্তা সম্পাদক ছিলেন মিন্টু বসু।রণাঙ্গণ নিয়ে মিন্টু বসুর অনেক লেখাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিল পত্র গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।তিনি দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল ও আজকের বার্তা পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক,দৈনিক গ্রাম সমাচার পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ,দৈনিক দেশবাংলা এবং দৈনিক বাংলার বাণীতে বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।দীর্ঘদিন তিনি একুশে টেলিভিশনের বরিশাল প্রতিনিধিও ছিলেন।বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছাড়াও বরিশাল প্রেসক্লাবের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মিন্টু বসু।নাটক,উপন্যাস, জীবনীগ্রন্থ ও মুক্তিযুদ্ধের উপর তার ৭৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে।তার প্রথম লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে।৮০’র দশকে তিনি শিশু সংগঠন চাঁদের হাটের মাধ্যমে বরিশালে শিশু নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলেন।দেশের অন্যতম প্রাচীন গ্রুপ থিয়েটার খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ২০ বছর।তার লেখা নাটকের সংখ্যা ৩৪।এরমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ১৪টি।১৯৯৪ সালে তার লেখা নাটক ‘বিপ্লবের মৃত্যু নেই’ মঞ্চস্থ হয় এবং বিশেষ এ্যাওয়ার্ড লাভ করে।তার একাধিক নাটক টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।ঢাকার নাট্য সংগঠন লোক নাট্যদল মিন্টু বসুকে ১৯৯৩ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্মীর পদকে ভূষিত করে।এছাড়াও বরিশালের প্রজন্ম নাট্যকেন্দ্র তাকে বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ পদক প্রদান করে।এ পর্যন্ত তিনি অর্ধশত নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন।তার লেখা নাটক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ,অপসংস্কৃতি এবং সামাজিক নীপিড়নের বিরুদ্ধে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছেন।সংগঠক হিসেবেও মিন্টু বসুর সুখ্যাতি রয়েছে।তিনি বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং একাধিকবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।মিন্টু বসু মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বরিশাল জেলা কমান্ডের সাবেক সদস্য,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব,বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাংস্কৃতিক সম্পাদকসহ বহু প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন।তিনি সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি ছিলেন।বরিশাল নাগরিক পরিষদের এক সময় সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি।ব্যক্তিগত জীবনে মিন্টু বসু এক কন্যা সন্তানের জনক।শারীরিক অসুস্থতা তার বর্ণাঢ্য জীবনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে, ছেড়ে যেতে হয়েছে এ পৃথিবীকে।
Post Views:
২৭৫
|
|