|
তৃতীয় মেয়র আহসান হাবিব কামাল তার বাজেটের শতকরা ৩৭.৭১% বাস্তবায়ন করেছেন
বরিশালের নির্বাচিত তিন মেয়রের বাজেট : এগিয়ে হিরন, পিছিয়ে সরোয়ার
মুক্তখবর ডেস্ক রিপোর্ট : ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ১৫টি বাজেট ঘোষণা করা হয়। এরমধ্যে পৃথকভাবে চারটি করে আটটি বাজেট ঘোষণা করেন বিএনপি সমর্থিত নির্বাচিত দুই মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার ও আহসান হাবিব কামাল। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র শওকত হোসেন হিরন মাত্র চারটি বাজেট ঘোষণা করেন। বাকি তিনটির মধ্যে দুইটি বাজেট ঘোষণা করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র বিএনপি নেতা আওলাদ হোসেন দিলু ও একটি আলতাফ মাহমুদ সিকদার। এসব বাজেট পর্যলোচনা করে দেখা গেছে, বরিশাল সিটির নগর পিতা হিসেবে বিএনপি নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার তার মেয়াদে সবমিলিয়ে বাজেটের শতকরা ২৪.২৬% বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। অপরদিকে দ্বিতীয় মেয়র শওকত হোসেন হিরন তার মেয়াদে বাজেটের শতকরা ৪৩.০১%। তৃতীয় মেয়র আহসান হাবিব কামাল তার বাজেটের শতকরা ৩৭.৭১% বাস্তবায়ন করেছেন। সূত্রমতে, ভোটে নির্বাচিত এ সিটির প্রথম মেয়র বিএনপি নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার তার প্রথম (২০০৩-২০০৪) বাজেট পেশ করেন ২০০৩ সালের ৭ জুলাই। বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওই বাজেটে ২শ’ ৩৩ কোটি ৩ লাখ টাকার প্রস্তাবিত বাজেটসহ ২০০২-০৩ অর্থবছরের সংশোধনী বাজেট আকারে মজিবর রহমান সরোয়ার প্রায় ২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। প্রথম বাজেটে তিনি (সরোয়ার) বলেন, নগরবাসীকে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বিশাল আকারের প্রস্তাবিত বাজেটের বছর শেষে বাস্তবায়ন করা হয় ২৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। যার শতকরা হার ছিলো ১২.৫৮%। ২০০৪ সালের ১২ জুলাই দ্বিতীয় বারের মতো বাজেট নিয়ে হাজির হন বিএনপির মেয়র সরোয়ার। ওইবছর ২শ’ ২১ কোটি ৭৪ লাখ ১ হাজার ৫৭২ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন। তিনবারের সংসদ ও একবার হুইপসহ বহুবার বিদেশ ভ্রমণকরা অভিজ্ঞ সরোয়ার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দুই বছরের মধ্যে অনেকটা অস্বস্থিতে পরেন। প্রথম বাজেট বক্তব্যের শুরুতে অনেক সাহস ও আশার বাণী শুনালেও দ্বিতীয় বাজেটের শুরুতে সরোয়ার বলেন, সিটি কর্পোরেশনে প্রয়োজনের তুলনায় আয় অপ্রতুল, কর্পোরেশনের নিজস্ব আয় দ্বারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও অফিস ব্যায় মিটানোর পর সু-বিশাল এলাকার উন্নয়ন কাজ করা খুবই কষ্টের।
এছাড়া প্রথম বাজেটে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি বেমালুন ভুলে গিয়ে ফের নগরবাসীকে আশার বাণী শোনান সরোয়ার। বছর শেষে ঘোষিত বাজেটের বাস্তবায়িত হয় প্রায় ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মাত্র। বাস্তবায়নের হার শতকরা ১৬.৯৪%।
তৃতীয় বারের মতো সিটি কর্পোরেশনে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ২০ হাজার ৭২২ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন মজিবর রহমান সরোয়ার। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করা হয় ২০০৫ সালের ২০ জুলাই। প্রথম ও দ্বিতীয় বাজেটের অনেকগুলো প্রতিশ্রুতির মধ্যে তৃতীয় মেয়াদে শুধুমাত্র বরিশাল অডিটিরিয়াম ভবন সংস্কার করা হয়। বাজেট বক্তৃতায় সরোয়ারের প্রথম ও দ্বিতীয় বাজেটের প্রতিশ্রুতিগুলো পুনরায় উল্লেখ করে বাস্তবায়নে পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলা হয়। এসব পরিকল্পনার পাশাপাশি লিখিত বক্তব্যের প্রায় ছয় পাতা জুড়ে নগরীর উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও আশ্বাসের কথা ফের উল্লেখ করেন সরোয়ার। এসব প্রকল্পের নামের শুরুতে লেখা হয়েছিলো-‘হাতে নেয়া হয়েছে, গৃহীত হয়েছে, খুব শীঘ্রই সম্পন্ন হবে, কাজ চলছে, অচিরেই শুরু হবে, প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’। বছর শেষে তার বাজেট বাস্তবায়িত হয় ৪৮ কোটি ১০ লাখ টাকা মাত্র। বাস্তবায়নের হার ছিল ১১৪.৬০%। ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই মেয়র হিসেবে চতুর্থ বাজেট নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সরোয়ার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরের ৩৩৩ কোটি ৪৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭৫ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হলেও তার শেষ বাজেট বক্তব্যে বিগতদিনে নানা প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেকে দায় মুক্তির চেষ্ঠা করেন মজিবর রহমান সরোয়ার। বছর শেষে বাস্তবায়িত হয় মাত্র ১৬৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার শতকরা ৪৮.৯০%।
মজিবর রহমান সরোয়ারের সবকটি বাজেটে নগরীর সড়ক-ড্রেন ব্যাবস্থাপনার উন্নয়নের কথা থাকলেও ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতাকালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আওলাদ হোসেন দিলু’র মুখে উঠে আসে ওইসব সড়ক ও ড্রেনের বেহাল অবস্থার কথা। এরপর দিলু দ্বিতীয়বারের মতো ২০০৮ সালের ১০ জুলাই বাজেট ঘোষণা করেন।
পরে নির্বাচিত হয়ে আসেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র শওকত হেসেন হিরন। ২০০৯ সালের ১০ জুলাই আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র শওকত হোসেন হিরন ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২৭২ কোটি ৭৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭৯ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন। বছর শেষে বাস্তবায়িত হয় প্রায় ১০১ কোটি ২১ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ৩৭.১০%। দ্বিতীয়বারের মত ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য ১৯৭ কোটি ৭২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৮৪ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন শওকত হোসেন হিরন। প্রথম বাজেটে প্রতিশ্রুতির মধ্যে হিরন ১৯টি প্রকল্পের অগ্রগতির সার্বিক বিষয় তুলে ধরে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। বছর শেষে বাস্তবায়িত হয় ১০৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ৫৩.৩৯%।
তৃতীয়বারের মত ২০১১ সালের ১৪ জুলাই বাজেট নিয়ে হাজির হন শওকত হোসেন হিরন। ২০১১-১২ অর্থবছরেন জন্য ২৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ৯২ হাজার ৪১৮ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেট বক্তব্যে উঠে আসে আধুনিক সুবিধাসম্বলিত অডিটরিয়াম, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন, পাইপলাইন নির্মান, হরিজনদের উন্নত বাসস্থান নির্মান, বিভিন্ন মার্কেট, বিবির পুকুরপাড় দখল মুক্ত করে সৌন্দর্য বর্ধন করে সেখানে ওয়াইফাই জোন নির্মান, নগরীরর বিভিন্নস্থানে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মান, শিশু পার্ক, সড়কে সৌন্দর্যবৃদ্ধিসহ নগরীতে বেশকিছু উল্লেযোগ্য উন্নয়ন কার্যক্রমের বড় ধরনের অগ্রগতির কথা। বছর শেষে বাস্তবায়িত হয় প্রায় ১১১ কোটি ৪৪ লাখ। বাস্তবায়নের শতকরা হার হিসেবে যা ছিল ৪৩.৮৮%। এখন পর্যন্ত এটাই বিসিসির তিন মেয়রের মধ্যে সেরা বাজেট বাস্তবায়ন।
২০১২ সালের ৩০ জুন চতুর্থ ও শেষ বাজেট ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরন। ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ৩২২ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯২ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেট বক্তব্যে তিনি নগরীর বিভিন্নস্থানে আশানুরূপ উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন। এছাড়া নগরীর রাস্তা-ঘাট উন্নতি, ড্রেনেজ ব্যাবস্থা, ফুটপাত নির্মান, মার্কেট নির্মান, খাল উদ্ধারে কার্যক্রমসহ একটি আধুনিক নগরী বাস্তবায়নে নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড শেষ ও চলামানের কথা উল্লেখ করে আরও বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলেন। বছর শেষে বাজেট বাস্তবায়িত হয় প্রায় ২২১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার শতকরা হিসেবে ছিল ৩৭.৬৬%। পশাপাশি তার বহুমুখী নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে একটি বাসযোগ্য আধুনিক মডেল শহর রূপান্তরে দ্বাড় প্রান্তে পৌছেন আওয়ামী লীগের মেয়র শওকত হোসেন হিরন।
পরে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে ২০১৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন বিএনপি নেতা আলতাফ হোসেন। কারণ এ বছর বিএনপির মেয়র আহসান হাবিব কামাল নির্বাচিত হলেও শপথ নিতে দেরি হয়েছিলো। তবে ওই বাজেট বাস্তবায়ন করেন বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামাল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৩৮১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন হয় ১৪২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ৩৭.৩৩%।
সূত্রমতে, বরিশাল সিটির নগর পিতা হিসেবে বিএনপি সমর্থিত তৃতীয় পরিষদের নির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামাল ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেটে ১৮২ কোটি টাকার সর্বোচ্চ উন্নয়ন প্রকল্প কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন করেন। এরপরেও তার মেয়াদে বকেয়া-বেতনের দাবীতে দীর্ঘদিন সিটি কর্পোরেশন অচল থাকাসহ নগরীর বেহাল সড়ক, জলাবদ্ধতা, পর্যাপ্ত আলোসহ বেশিরভাগ নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত ছিলেন নগরবাসী।
২০১৪ সালের ২২ জুলাই প্রথমবারের মত বাজেট নিয়ে আসেন বিএনপির মেয়র আহসান হাবিব কামাল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ওই বাজেটে ৪০৭ কোটি ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার ৯৭৫ টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেট বক্তব্যে নিজের কিছু উন্নয়ন কাজ করার কথা উল্লেখ করে আরও কিছু উন্নয়ন কাজের আশ্বাস দেন কামাল। বছর শেষে ঘোষিত বাজেটের বাস্তবায়িত হয় ১৪৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার শতকরা হিসেবে ছিল ৩৬.১৫%।
২০১৫ সালের ২৬ জুলাই ৪২৩ কোটি ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৬ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র কামাল। বছর শেষে বাজেটের বাস্তবায়িত অর্থ ব্যয় হয় ১৮২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার শতকরা হিসেবে ৪৩.১৮%।
তৃতীয়বারের মত ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট বাজেটে বিএনপি দলীয় মেয়র আহসান হাবিব কামাল ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৪৪৪ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৬৫ টাকা। বাজেট বক্তব্যে উন্নয়নে গ্রীণ সিটি পার্ক নির্মনের কথা উল্লেখ করেন। তবে তা বছর ঘুরতেই অচল হয়ে পরে। বছর শেষে বাস্তবায়িত হয় ১৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার শতকরা হিসেবে ৩৪.১৭%।
২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট চতুর্থবারের মত বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র কামাল। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ ওই বাজেটে ৪০৬ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২৮ টাকা বরাদ্দের কথা ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত বিএনপি দলীয় মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারের মত তিনিও বেমালুন ভুলে যান প্রথমসহ পর পর কয়েকটি বাজেটে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতির কথা। তবে পরবর্তী বাজেট ঘোষণা না দেয়ার কারণে চলতি অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়িত ও শতকরা হিসেব পাওয়া যায়নি।
Post Views:
১,১০৭
|
|