|
বৈরী পরিবেশের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা
আগৈলঝাড়ার লাল শাপলা এখনও প্রকৃতি প্রেমীদের মুগ্ধ করে
শামীম আহমেদ, অতিথি প্রতিবেদক : বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার খাল-বিলে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা।এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সবার চেয়ে বেশী। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বিল-ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় লাল শাপলা।এর বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaca Nouchali।স্থানীয়ভাবে Water Lily নামেও এটি পরিচিত।এটি একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ।আবহমান কাল থেকে শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।আগৈলঝাড়ার বিলাঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষেরা অভাবী সংসারে এক সময় শাপলা খেয়েই জিবীকা নির্বাহ করার কথা মানুষের মুখে এখনও শোনা যায়।সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধী গুনে সমৃদ্ধ।ছোটদের কাছে শাপলা ফুল একটি প্রিয় খেলানার পাশাপাশি অনন্ত সৌন্দর্যের আকর্ষণ।উপজেলার দক্ষিণ পশ্চিম বারপাইকা গ্রামের প্রবীন ফেলু হালদার (৬০),সুধীর কীর্তনীয়া (৭৫) জানান,কয়েক বছর আগেও বর্ষা কাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিল এলাকায় মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম রক্ত শাপলা বা লাল শাপলা।শুধু উপজেলার দক্ষিণ পশ্চিম বারপাইকা গ্রামই নয় এখনও লাল শাপলার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায় আস্কর,নাঘিরপাড়,চাঁদত্রিশিরা,কড়াইবাড়ি বিল কদমবাড়ি,চৌদ্দমেধা বিল,আমবৌলা,কুড়লিয়া,রামশীল,শুয়াগ্রামসহ বিচ্ছিন্ন এলাকার জলাশয়ে।বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারী রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত।মনে হত কোন এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি।এদৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবেনা।ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুঁটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা।অনেকে আবার শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বিক্রি কম করলেও স্বরুপকাঠির আটঘর,কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাট,পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন বর্ষা মৌসুমে বড় বড় নৌকায় করে তাদের এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়।এ শাপলা শহুরে জীবনেও খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনগনের চাঁপের কারণে আবাদী জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বিলের পরিমান যেমন কমছে,তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে।তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ,জলবায়ু পরিবর্তন,খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারনে আগৈলঝাড়া উপজেলার বিলাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা।এখন খাল-বিল ও জলাশয় থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা।অনেকে সৌন্দর্যের জন্য পুকুরেও চাষ করত লাল শাপলা।তবে ওই সকল পুকুরে কার্প জাতীয় মাছ যেমন- রোবোকার্প,গ্রাস কার্প মাছ চাষের ফলে শাপলার বংশ বিস্তার সমুলে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে।আগৈলঝাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন জানান,সাধারণত শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে।এর মধ্যে সাদা, বেগুনী (হুন্দি শাপলা) ও অন্যটি লাল রংয়ের।এরমধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধী কাজে ব্যবহৃত হয়।শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি।সাধারণ শাক-শবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি।শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম।শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি।তিনি আরো বলেন, শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী।তাছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ্বালা, লিভার,ইউরিনারী সমস্যার সমাধানসহ নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।প্রতি ১’শ গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, এ্যাশ ৮.৭ গ্রাম,খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলো,ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম,শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম,ফসফরাস ০.৩২,ড্রাই মেটার ৮.৪,ক্রুড আমিষ ১৬.৮,ক্রুড ফ্যাট ২.৮ ক্রুড ফাইবার ৬২.৩,নাইট্রোজেন ৩৫.৪,সোডিয়াম ১.১৯,পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ।ঐতিহাসিক কাল থেকেই শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খৈ ভাজা যায়।যেটি গ্রামগঞ্জে ঢ্যাপের খৈ বলে পরিচিত।মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে।নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিল-ঝিল-হাওড়-বাঁওড়-পুকুরের পানি যখন কমে যায় তখন শালুক তুলে খাওয়া হত,তা খেতেও বেশ সু-স্বাদু।তবে আমাশয়ের জন্য এটি খুবই উপকারী। বানিজ্যিকভাবে শাপলার চাষাবাদ না হওয়ায় স্থানীয় কৃষি অফিসে এর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ওই কর্মকর্তার দাবি আগৈলঝাড়ায় অন্তত ৪০-৫০ হেক্টর জমিতে শাপলা জন্মায়।তবে,স্থানীয় কৃষকরা আরও বেশী বলে জানিয়েছে।অনেকের কাছে শাপলা সৌন্দর্য আর আনন্দের বিষয় হলেও কৃষকের কাছে চরম বিরক্তিকর বলে দাবি করেছেন কৃষক দিনু বিশ্বাস,শ্যামল মন্ডল,জুরান বিশ্বাসসহ অনেকেই।তারা বলেন,বোরো মৌসুমের আগে জমিতে চাষাবাদের জন্য এই শাপলার কারণে জমি পরিস্কার করতে তাদের গুনতে হয় সাধারণের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ।ভাল চাষ না করতে পারলে জমিতে ফলনও কম পাওয়া যায়।উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা খলিলুর রহমান জানান,খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো শুকিয়ে রাখার কারনে শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্র নষ্ট হলেও সরকারিভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
Post Views:
১,১২৫
|
|