|
সরকারের দেয়া সম্মানি ভাতাসহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত অসহায় পরিবার দুটির সদস্যরা
বরিশালের অবেহেলিত দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা
দেশ স্বাধীনের পর ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে সরকারী অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল এর ভাস্কর্য ও বরিশালের উজিরপুরের দশজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে উপজেলা পরিষদের সামনে স্মৃতিফলক নির্মান করা হয়। ওই ফলকের দ্বিতীয় নামটি হচ্ছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুরুল হক হাওলাদারের এবং চতুর্থ নামটি হলো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃ মজিদ হাওলাদারের। স্মৃতিফলকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নুরুল হক ও মজিদ হাওলাদারের নাম শুধু স্মৃতি হয়ে থাকলেও সরকারের দেয়া সম্মানি ভাতাসহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন অসহায় ওই দুটি পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক হাওলাদার : ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল আটটার দিকে যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকায় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ব্যারাকপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুরুল হক। ওই যুদ্ধে ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছিলেন নুরুল হকের সহকারী আবুল হোসেন হাওলাদার। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক মোঃ নুরুল হক হাওলাদারের অসহায় বিধবা কন্যা ফেরদৌসি বেগম তার বাবার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করার জন্য সদ্যসমাপ্ত উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটির কাছে আবেদন করেও কোন সুফল পাননি। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র শক্তি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
উজিরপুর উপজেলার হস্তিশুন্ড গ্রামের আব্দুল আজিজ হাওলাদারের পুত্র তৎকালীন বিমান বাহিনীর কর্পোরাট অফিসার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক হাওলাদারের জেষ্ঠ কন্যা বিধবা ফেরদৌসি বেগম বলেন, বাবার লাশ কোথায় দাফন করা হয়েছে আমরা তা আজও জানতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আমাদের তিন ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে মা নুরজাহান বেগম চরম আর্থিক দৈন্যতায় পরেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় ১৯৯০ সালে মা মারা যান। বিধবা ফেরদৌসি বেগম আরও বলেন, আমার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পিতা নুরুল হক হাওলাদারকে সম্মান জানিয়ে সরকারী অর্থায়নে উপজেলা পরিষদের সামনে বিশাল নামের স্মৃতিফলক করা হলেও আজও আমরা সরকারীভাবে বরাদ্দকৃত সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটে আমার বাবার নাম থাকা সত্বেও আমরা মাসিক ভাতাও পাচ্ছি না। এজন্য আমিসহ অন্যসব ভাই ও বোনেরা সংশ্লিষ্টদের কাছে দীর্ঘদিন ধর্ণা দিয়েও কোন সুফল পাইনি। আক্ষেপ করে বিধবা ফেরদৌসি বেগম বলেন, অন্যসব ভাই ও বোনেরা কোন একমতে জীবন-যাপন করলেও বর্তমানে আমি চরম আর্থিক সংকটে ভূগছি। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে আমি মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। অথচ বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারীভাবে বাড়ি করে দেয়াসহ অসংখ্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করলেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে আমরা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছি। বর্তমানে বরিশাল নগরীর একটি ভাড়া বাড়িতে বিধবা ফেরদৌসি বেগম তার সন্তানদের নিয়ে কোন একমতে দিনাতিপাত করছেন।
সূত্রমতে, দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদিয়ে দেশ মাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন বিমান বাহিনীর কর্পোরাট অফিসার নুরুল হক হাওলাদার ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম.এ জলিলের সাথে দেখা করেন। ওইসময় তার নির্দেশে তিনি (নুরুল হক) একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে গ্রামের যুবকদের একত্রিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতেন। এছাড়া পূর্ব প্রশিক্ষণ থাকায় তিনি (নুরুল হক) রহমতপুর এলাকায় পাক সেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেন। এজন্য স্থানীয় রাজাকার ফজলে কারিকর ও শিকারপুর এলাকার শীর্ষ রাজাকার গফুর মৃধা পাক সেনাদের নিয়ে নুরুল হক হাওলাদারকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার হস্তিশুন্ড গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। ওইসময় বাড়িতে কাউকে না পেয়ে হায়নারা নুরুল হক হাওলাদারের ঘরে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। হস্তিশুন্ড গ্রামে এটাই প্রথম পাক সেনাদের হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এরপর থেকেই পরিবার-পরিজনকে পাশ্ববর্তী গ্রামের নিকট আত্মীয়র বাড়িতে রেখে মুক্তিযুদ্ধের দক্ষ সংগঠক হিসেবে নুরুল হক হাওলাদার গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে দল গঠন করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতেন।
সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমাদের ৩০জনের একটি দল নিয়ে নুরুল হক হাওলাদার ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল আটটার দিকে যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকায় পৌঁছামাত্রই পাক সেনারা আমাদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। এসময় আমাদের দলের নেতৃত্ব দেয়া নুরুল হক হাওলাদারের কাছে শুধু একটি রাইফেল ছিলো। তিনি আমাদের জীবন বাঁচাতে নিরাপদে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে পাক সেনাদের ওপর পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে পাকিদের ছোঁড়া একাধিক বুলেট এসে আমাদের দলের নেতা নুরুল হক হাওলাদার ও সদস্য আবুল হোসেনের বুক ছিদ্র হয়ে বের হয়ে যায়। সেদিন প্রাণ বাঁচাতে আমরা পাশ্ববর্তী ডোবার কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়েছিলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে বয়রা ক্যাম্পের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাল্টা আক্রামন চালালে পাক সেনারা পিছু হটে পালিয়ে যায়। বেশ কিছুসময় গুলির শব্দ না পেয়ে আমরা ডোবা থেকে উঠে দেখি পাকিস্তানদের বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন। আর আমাদের দলের নেতা নুরুল হক হাওলাদারের শরীরে একাধিক বুলেট এসে আঘাত করায় তিনি রক্তাক্ত জখম হয়ে ছটফট করছেন। তাৎক্ষনিক ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশে তার সহযোদ্ধারা তড়িঘড়ি করে নুরুল হককে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে ভারতের ব্যারাকপুর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দুইদিন চিকিৎসার পর ৮ সেপ্টেম্বর তিনি (নুরুল হক) মারা যান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার ও মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর হোসেন হাওলাদার আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী ভাতা পেয়ে আসছি। কিন্তু যার অনুপ্রেরণা ও সহযোগীতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যিনি আমাদের বাঁচাতে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। সেই মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক নুরুল হক হাওলাদারের ছেলে-মেয়েরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে আজও তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এটা জাতির জন্য একটি লজ্জাজনক বিষয়।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃ মজিদ হাওলাদার : মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও স্মৃতিফলকে নাম থাকলেও ভাতার তালিকায় এখনও নাম নেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃ মজিদ হাওলাদারের। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজও পায়নি স্বীকৃতি ও সম্মাননা। ১৯৭১ সালে তার একমাত্র প্রতিবন্ধী পুত্র ছালেক হাওলাদার চুন্নুর বয়স যখন দেড় বছর তখন শিশু সন্তান ও স্ত্রী পরিবার ছেড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের মুন্ডপাশা গ্রামের মৃত কসিম উদ্দিনের পুত্র আঃ মজিদ হাওলাদার। যুদ্ধ চলাকালীন সময় ভোলার জেলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের লেজপাতা গ্রামে পাকহানাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি (মজিদ) ও তাঁর দুই সহযোদ্ধা শহীদ হন। স্বাধীনতার বিজয় পতাকা হাতে সহযোদ্ধারা এলাকায় ফেরার পর মজিদ হাওলাদারের স্ত্রী সামসুন্নাহার বেগম জানতে পারেন তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাকে ভোলার বর্তমান দৌলতখান উপজেলার দাস বাড়ীতে দাফন করা হয়েছে। উপজেলা চত্বরে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলের ভাস্কর্যসহ শহীদদের স্মৃতিফলকের চতুর্থ স্থানে আঃ মজিদ হাওলাদারের নাম থাকলেও আজও তাঁর পরিবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। বৃদ্ধা সামসুন্নাহার তার মৃত্যুর পূর্বে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর স্বীকৃতি পেতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডরসহ বিভিন্নস্থানে ধর্ণা দিয়েও কোন সুফল পাননি। স্মৃতিফলকে আর গেজেটে নাম থাকলেও ভাতার তালিকায় নাম নেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃ মজিদ হাওলাদারের।
- শামীম আহমেদ, অতিথি প্রতিবেদক
Post Views:
৩১৯
|
|