আংটি ও পাথরে কী ভাগ্য বদলায়? – এটি একটি গহনা বিশেষ
পাথর কোনোভাবেই ভাগ্য ফেরাতে পারে না, নিছক কুসংস্কার!
অঙ্গশোভার জন্য হাতের আঙ্গুলে আংটি কিংবা সেই আংটিতে পাথর লাগিয়ে পরাটা অতি প্রাচীন একটি প্রচল। পৃথিবীর সব দেশেই এই প্রচল রয়েছে। এক্ষেত্রে এটি একটি গহনা বিশেষ। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আংটিতে বিভিন্ন ধরনের পাথর ব্যবহারের রীতিটিও বিশ্বজনীন। কতকাল আগে থেকে এই রীতি চলে আসছে তা বলা সত্যি খুবই মুশকিল! ভাগ্য পাথর ব্যবহার দ্বারা বদলানো যায়-এটা কেউ বলেন, নিছক কুসংস্কার। কেউ বিশ্বাস করেন-খাঁটি এবং যথাযথ পাথর ব্যবহার করলে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তিত হবেই। কেউ ভাবেন, মানবদেহের ওপর পাথরের রাসায়নিক ক্রিয়া একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। কেউ বা ধারণা করেন, পাথর মানুষের স্বাস্খ্যের ওপর নিশ্চিত প্রভাব ফেলে। এই সব মত-অমতের ভিতর দিয়ে হাজার-হাজার বছর ধরে যেমন অ্যাসট্রলজি বা জোতিষশাস্ত্র এই প্রবল বিজ্ঞানের সুগেও সারা বিশ্বে চালু রয়েছে, তেমনই চালু রয়েছে পাথরের ব্যবহার। মজার কথা, পৃথিবীর নানা দেশে বহু বিজ্ঞান-মনষ্ক মানুষ, এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত গ্রহের অশুভ প্রভাব কাটানোর জন্য এবং সৌভাগ্যলাভের আশায় জোতিষীর পরামর্শ অনুযায়ী আংটিতে নানা ধরনের পাথর ব্যবহার করছেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি একজন চিৎকার করছেন—অষ্টধাতুর আংটি নেন, ভাগ্যটাকে বদলে দেন। পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আংটিতে কী কী ধাতু আছে? আংটি বিক্রেতা এক নিশ্বাসে বললেন, সোনা, রুপা, তামা, সিসা, পিতল, ব্রোঞ্জ, জিঙ্ক, লোহা। এই ছন্দ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। আসলে পিতল ও ব্রোঞ্জ কোনো ধাতু নয়, ধাতুর মিশ্রণ! জিজ্ঞেস করলাম, অষ্টধাতু একসঙ্গে মেশালেন কি করে? বললেন, গলাই-মিশাই। তাকে বিজ্ঞান শেখানোর ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি সেখান প্রস্থান করলাম। আসলে আটটি ধাতু মেশানো সহজ কাজ নয়! ধাতুর (Metal) মিশ্রণকে বলা হয় শংকর-ধাতু (Alloy)। চাইলেই সব ধাতু, যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে মেশানো যায় না। দোঁয়াশ মাটি ও বেলে মাটি যেমন একসঙ্গে মিশিয়ে গড়া যায় না প্রতিমা। অষ্টধাতুতে ভাগ্য বদলায় কীভাবে? কোনোভাবেই না। ধাতুর সঙ্গে ভাগ্যের সম্পর্ক ভিত্তিহীন। মানুষের শরীরে অষ্টধাতু নয়, বহু ধাতু আছে। রক্ত-কণিকা, হাড়, কোষের গঠনে ধাতু মিশে আছে। আমাদের প্রতিদিনকার খাবারেও বিভিন্ন ধাতু (Metal) থাকে। শরীরের কোষে কোষে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা ধাতুই যদি ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পারে, বাহ্যিক ধাতব অলংকার ভাগ্য বদলায় কী করে? বিভিন্ন পাথরের প্রতিও মানুষের গভীর বিশ্বাস দেখা যায়। প্রকৃতিতে বহু বর্ণ ও গঠনের পাথর পাওয়া যায়। এসব পাথর মূলত: বিভিন্ন মৌলের যৌগ। যেমন: রুবি পাথর হলো অ্যালুমিনিয়ামের যৌগ। মূলবান হিরা হলো কার্বন। মুক্তা হলো ক্যালসিয়ামের যৌগ। পাথরে বিভিন্ন ধাতুর উপস্থিতির কারণে এরা বর্ণে ও গঠনে আলাদা। প্রাচীনকাল থেকেই এসব পাথরের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এদের আর্থিক মূল্য ছিল বেশি। ধনাঢ্য মানুষেরা এগুলোর ব্যবহার করে আভিজাত্যের প্রতীক করেছে। সাধারণের কাছে করেছে লোভনীয়। যেমন: হিরা যদি লোহার মতো সহজলভ্য হতো, তাহলে হিরার প্রতি মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকত না। একসময় চিকিৎসাবিজ্ঞান আধুনিক ছিল না। দুষ্প্রাপ্য পাথরকে মানুষ রোগমুক্তির জন্য ব্যবহার করে মানসিক তৃপ্তি পেত। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা পাথরে খুঁজে পেল অর্থপ্রাপ্তির মানসিক আস্থা। দরিদ্র সমাজে তাই পাথর হয়ে গেল ধনী হওয়ার উপায়। মূলত: এটা আসে দারিদ্র্য মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে। আংটি পরে কপাল খুলে গেছে, এমন গল্পের শেষ নেই। সকল পাথর, বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগের মিশ্রণ। ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নিজেকে অলংকৃত করতে পাথর কিংবা আংটি ব্যবহার করা যায়। তবে এসব ব্যবহারে ধনী হওয়া, রোগমুক্তি, ভাগ্য বদলানোর যে গল্প প্রচলিত সেগুলো শুধুই রূপকথা। নিউটন, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, নীলস বোর, বিল গেটস কিংবা স্টিভ জবসের আংটি বা পাথর ব্যবহারে ভাগ্য বদলায়নি। এ যাবৎ অন্তত দুই ডজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী দেখেছি। তাদের কারও আঙুলে ভাগ্য বদলানো আংটি দেখিনি।
বোধহীন মানুষ আংটির কাছে ভাগ্য জমা রাখে, বোধসম্পন্ন মানুষ রাখে কর্মে।
আজমেরি জেমস হাউজের মালিক লিটন দেওয়ান এত মানুষের ভাগ্য বদলে দেন। অথচ তিনিও প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। রত্নপাথর বিক্রি করেই আজ বাসের হেল্পার লিটন দেওয়ান বহু বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।
পরিশেষে এতটুকই বলবো বা বলতে চাই, পাথরে যদি সত্যি সত্যিই ভাগ্য ফিরতো তাহলে যিনি বা যারা এসব পাথর বিক্রি করেন তারা তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই আগে ফেরাতেন!