|
নষ্ট হচ্ছে ওদের কারণে !
নগরবাসীর প্রাত: ভ্রমন ও সন্ধ্যা হাঁটার সুস্থ্য পরিবেশ
সুব্রত বিশ্বাস : ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বরিশাল বেলস্ পার্ক (বঙ্গবন্ধু উদ্যান) এর পরিবেশ দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।এখানে সবুজের এই গালিচায় মুক্ত বাতাস উপভোগ করতে আসা মানুষরা বখাটে কর্তৃক যৌন হয়রানী,সিগারেট কিংবা গাঁজার গন্ধসহ প্রেমিক জুটিদের নির্লজ্জ বেহায়াপনায় প্রতিনিয়ত বিব্রত হচ্ছেন উদ্যানে বেড়াতে আসা ভ্রমন পিপাসু মানুষরা।বাড়তি ঝামেলা হয়ে দাড়িয়েছে তরুন-তরুনীদের ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ছবি ধারন ও সর্ট ফিল্মিমের সুটিং এর কারনে।সবকিছু মিলিয়ে অসহনীয় হয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পরিবেশ।কারও কাছে নালিশ কিংবা অভিযোগ দিয়ে এর কোন সুরাহ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন এখানে বেড়াতে আসা মানুষেরা।এ বিষয়ে অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন,বঙ্গবন্ধু উদ্যান জেলা প্রশাসকের মালিকানাধীন।ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের।সিটি কর্পোরেশন তারপরও দেখাশোনা করে,গাছপালা লাগায়,ঘাস কাটে,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে।বঙ্গবন্ধু উদ্যানের সৌন্দর্য রক্ষাসহ বিভিন্ন কাজে সিটি করপোরেশনের ১০ জন কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে।কিন্তু তাদের কেউ মানছে না।অনেক সময় তারা মারও খায়।পুলিশকে বিকালে সেখানে তদারকির জন্য অনুরোধ করেছিলেন।কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।প্রায় ১ লাখ বর্গমিটার আয়তনের বঙ্গবন্ধু উদ্যানের (বেলর্স পার্ক) মাঝখানে একটি হেলিপ্যাড।সুবিশাল মাঠের একপাশে স্থায়ী পাকা মঞ্চ।পুরো মাঠের চারদিকে দুই লেনের সুপ্রশস্ত পাকা ওয়াকওয়ে।ফাঁকে দুটি বিশ্রামাগার এবং বসার জন্য ছাতা আকারের কয়েকটি পাকা স্থাপনা।মাঠের চারদিকে করা হয়েছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা।মাঠ লাগোয়া দৃষ্টিনন্দন বিশাল লেক।লেকের পশ্চিম পাশেই জেলা প্রশাসকসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরকারি বাসভবন।মাঠের পূর্ব পাশে দীর্ঘলেক এবং লেকের ওপর বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে।বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আগে সীমিতসংখ্যক মানুষ সকাল-বিকাল হাঁটাচলা করত আবার অনেকে পরিবার-পরিজন,বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বেড়াত।প্রয়াত সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের আমলে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের আধুনিকায়ন করা হলে মানুষের আকর্ষণ অনেক বেড়ে যায়।সেখানে দিনভর প্রচুরসংখ্যক মানুষ মুক্ত বাতাসে হাঁটতে আসেন।একই সঙ্গে বাড়তে থাকে সৌন্দর্যপিপাসুদের ভিড়।সরকারি ছুটির দিনে এবং প্রতিদিন বিকালে-সন্ধ্যায় সেখানে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে।মাঠের মধ্যেও বছরের বিভিন্ন সময় নানা ধরনের খেলা হয়।চাকুরীজীবি চয়দ দাস বলেন,কপোত-কপোতিরা বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পরিবেশ একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে।এটি দেখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের হলেও তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।সেখানে হাঁটতে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে নিয়মিত হাঁটতে যাওয়া ডাক্তার হাসান মাহমুদ জানান,বখাটে এবং প্রেমিক জুটিদের অশালীন কার্যকলাপে মানুষ বিব্রত বোধ করেন।পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা মানুষ প্রেমিক জুটির ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখলে দ্বিতীয়বার আসতে চায় না।বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) গোলাম রউফ খান বলেন,বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অনেক জুটি বসে।আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা সেখানে বসে একটু গল্প করতে পারে।কিন্তু এই সুযোগে কেউ অশ্লালীন কাজ করলে তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।এদিকে: বরিশালের ইতিহাস আর ঐতিহ্য মিশে আছে বঙ্গবন্ধু উদ্যান ঘিরে।এই উদ্যান যেমন বৃটিশ উদ্যোগের স্মারক তেমনি এর সাথে মিশে আছে আমাদের জাতীয় জীবনের নানা ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিক অনুষঙ্গ।১৮৯৬ সালে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এন ডি বিটসেন বেল বরিশালে আসেন।বৃটিশ এই কর্মকর্তা নানা কারণেই বরিশালে প্রাতস্মরণীয় হয়ে আছেন।বিটসেন বেল ও খান বাহাদুর হেমায়েত উদ্দিনের প্রচেষ্টায় বরিশালের মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য বেল ইসলামিয়া হোষ্টেল নামে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়।বেল সাহেবের আরো অবদান রয়েছে।বরিশালে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হলে তিনি এর নির্মূলে ঝাপিয়ে পড়েন। তবে তাঁর নাম মিশে আছে বঙ্গবন্ধু উদ্যান ঘিরে।এই উদ্যান নির্মাণে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বিটসেন বেলের অনন্য প্রচেষ্টার নিদর্শন স্বরুপ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এটি ‘বেলস্ পার্ক’ নামে পরিচিত ছিল।জনশ্রুতি আছে,রাজা পঞ্চম জর্জের বরিশাল শুভাগমনকে স্মরণীয় করতে এই মাঠটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন বেল সাহেব।কিন্তু কোন কারণে সে সময় এই কর্মসূচী বাতিল হয়ে যায়।তারপর থেকে সরকারি বেসরকারি সকল বৃহৎ কর্মকাণ্ড এই মাঠ ঘিরেই সম্পন্ন হয়।এই মাঠটি গড়ে তুলতে বিটসেন বেল বেশ দুরদৃষ্টির পরিচয় দেন।সে সময়ে কীর্তনখোলা নদী আরো এগিয়ে ছিল।কীর্তনখোলার তীর ঘেষে সবুজের এই গালিচা এক অনন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ রচনা করেছিল।১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এর নামকরণ করে ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’।সেই থেকে দাপ্তরিকভাবে এটি ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’ নাম হলেও সাধারণের কাছে এটি আজো ‘বেলস্ পার্ক’ নামে সুপরিচিত।বঙ্গবন্ধু উদ্যানটি সব মিলিয়ে লম্বায় ৭৫০ ফুট।প্রস্থে এটি ৫৫০ ফুট।তবে এটি উদ্যান ও পাশের লেক সহ সম্পূর্ণ হিসাব।শুধুমাত্র উদ্যান টি লম্বায় ৫৫০ ফুট ও পাশে ৪৫০ ফুট।উদ্যানটি ঘিরে রয়েছে ওয়াকওয়ে।রয়েছে অসংখ্য বাহারী বৃক্ষ।উদ্যানের উত্তর পাশে বাহারি লেক এর সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।রাতে সবুজ ঘাসের পরে নান্দনিক আলো উদ্যানকে সৌন্দর্যকে শুধু বাড়ায়নি,তাকে অনন্য করে তুলেছে।বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মাঝে সবুজ ঘাসের গালিচা ছাড়াও এর চারদিকে রয়েছে ফুলের বাগান ও ছায়াদানকারী বৃক্ষ।রয়েছে বসার বেঞ্চ ও ছাতি।বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দক্ষিণ পাশে রয়েছে বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় ম্যুরাল।জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এই ম্যুরালটি শিল্পী আমিনুল হাসান লিটু ও শিল্পী হাফিজ উদ্দিন বাবুর তৈরি।বর্তমানে এই বৃহৎ উদ্যানের ওয়াকওয়েতে সকাল-সন্ধ্যায় হেটে ভ্রমণ করেন কয়েক হাজার মানুষ।সন্ধ্যায় আলোক উদ্ভাসিত এই উদ্যানটি এখন নগরবাসির অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া,সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের নেতা নেত্রীরা বক্তৃতা করেছেন।স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এখানে ভাষণ দেন।এ সময় এই আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে সেখানে একটি ‘মুক্ত মঞ্চ’ করা হয় যা আজও দাঁড়িয়ে আছে।বঙ্গবন্ধু উদ্যানে জনসমাবেশ বা যে কোন উৎসব ঘিরে এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ দেখা যায়।বঙ্গবন্ধু উদ্যানে কৃষি ও শিল্প প্রদর্শণী,বৃক্ষমেলা,বাণিজ্যমেলা,কুচকাওয়াজসহ সকল পর্যায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃুতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।বরিশালের সকল বৃহৎ সমাবেশ,ঘোষণা,মেলা, উৎসব এই উদ্যানকে ঘিরেই।উদ্যানটির মালিকানা গণপূর্ত বিভাগের হলেও এর রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন (বিসিসি)।এখানে দেখভালের জন্য সিটি কর্পোরেশনের আলাদা লোক রয়েছে।তারা পানি ছিটায়,গাছ ছেঁটে দেয়।বঙ্গবন্ধু উদ্যান ঘিরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছিলো বরিশালের সাবেক সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সময়।২০১১ সালে প্রায় কোটি টাকা ব্যায়ে এখানে আলোকসজ্জা ও সোন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হয়।বর্তমানে পার্কটি একটি আদর্শ সবুজ উদ্যানে পরিণত হয়েছে।বঙ্গবন্ধু উদ্যান বরিশালে এক পর্যটন কেন্দ্রের রুপ নিয়েছে।প্রায় সোয়াশো বছর আগে বেল সাহেব যে সৌন্দর্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন তা আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে।এই উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সমর শিক্ষা দিতেন মেজর জলিল।এই উদ্যানের সাথে জাতীয় সকল সংগ্রাম ও ঘটনা প্রবাহ ঘিরে উদ্যানটিকে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
Post Views:
৩৪২
|
|