|
৫০ থেকে ১শ’ টাকা দিলেও রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না ট্রলি
দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের আতুরঘর বরিশাল শেবাচিম!
মো: আরিফ হোসেন, অতিথি প্রতিবেদক : দক্ষিনবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা কেন্দ্র বরিশাল শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বর্তমানে সেখানে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ঘুষ, দুর্নীতি ও বকশিসের নামে অর্থ বাণিজ্যের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নার্স, ব্রাদার, ট্রলি বয়, লিফটম্যান থেকে শুরু করে সবখানেই ঘুষ আর বকশিস দিতে দিতে সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। পরিচালক ডা: বাকির শত চেষ্টা করেও বৃহৎ সু-চতুর এসকল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে ট্রলিতে ওঠানামার ক্ষেত্রে ট্রলিম্যানদের ৫০ থেকে ১শ’ টাকা না দিলে ট্রলি জুটে না রোগীদের। তাদের খাবার চলে যায় হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেটে। সরকারি ওষুধ বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বাইরের মার্কেটে। হাসপাতালের নামী দামী যন্ত্রপাতি ক্রয় করে তা অযত্নে আর অবহেলায় ফেলে রেখে সরকারের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার ও সেবিকা থেকে আয়াদের টাকা ছাড়া সেবা মেলাই দুষ্কর! ফলে রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত সেবা থেকে। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গরিবরা ব্যাপক বৈষম্যে ও চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ধনী ও মধ্যবিত্তরা বেসরকারি খাত থেকে সেবা কিনতে পারলেও গরিবরা টাকার অভাবে মৌলিক অধিকার সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান মতে, মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা পেতে ৬৪ শতাংশ টাকা নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। তবে শেবাচিমের বেলায় পুরোটাই পকেট থেকে কাটা হয়। গরিবের টাকা খরচের সামর্থ্য না থাকায় তাদের জন্য সেবাও নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৯৬৮ সালে বরিশাল নগরীর আলেকান্দায় বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৫ তলা বিশিষ্ট এই হাসপাতালের ওয়ার্ড গুলোতে গড়ে দৈনিক রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় ১২০০। এ ছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগেও চিকিৎসা নেয় প্রায় দুই হাজার রোগী। পথ্য, ওষুধসহ সব বিভাগের বরাদ্দ দেওয়া হয় হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী। তারপরও রোগীদের অভাব-অভিযোগের যেন অন্ত নেই। জরুরি বিভাগে প্রবেশের পর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বের হওয়া পর্যন্ত পদে পদে রয়েছে বকশিসের অলিখিত বিধান। অসুস্থ একজন রোগীকে শেরেবাংলা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ১১ টাকার টিকিট কাটতে হয়। টিকিট দেখেই রোগীকে ‘ওয়ার্ডে ভর্তি’ লিখে দেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক। এরপর ভর্তি টিকিট কিনতে হয় আরও ১৫ টাকায়। মোট ২৬ টাকায় একজন রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তির কথা থাকলেও ‘ভাংতি নেই’ অজুহাতে গ্রামের রোগীদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এখান থেকে একজন রোগীকে ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে পাঠাতে হলে সংশ্লিষ্টদের দিতে হয় বকশিস নামের উৎকোচ। না দিলে রোগীকে কোলে-পিঠে করে ওয়ার্ডে নিতে বাধ্য হন স্বজনরা। চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে চলে যাওয়ার সময়ও একইভাবে হয়রানির শিকার হন রোগী ও তাদের স্বজনরা। ভর্তি রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের মানও যাচ্ছেতাই। বকশিস না দিলে হয়রানি আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই জোটে না রোগীদের। অনুসন্ধান বিভাগে বহিরাগত দালাল আর কর্মচারীদের আড্ডা। বহির্বিভাগে দেখা যায় রোগীদের দীর্ঘ সারি। ভেতরে গেলে দেখা যায়, রোগী নয়, চিকিৎসকরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে খোশগল্পে মশগুল। যদিও পূর্বের পরিচালকের তুলনায় বর্তমান পরিচালক ডা: বাকিব অনিয়ম দুর্নীতি রোধে অনেকটাই সোচ্চার। তবুও তার চোখ এড়িয়ে সবকিছু চলছে যেন সমান তালেই। এই হাসপাতালে রোগ পরীক্ষার যত যন্ত্রপাতি আছে, তা বরিশালের সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও নেই। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এবং এম আর আই মেশিন থাকে বিকল! ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে মোটা মাসোয়ারা নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে রোগ পরীক্ষার যন্ত্রগুলো বিকল করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে অংশীদারিভিত্তিক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের খোদ টেকনিশিয়ান এবং রেডিওগ্রাফারদের বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের জন্য সরকারিভাবে এই হাসপাতালে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হলেও রোগীদের রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকে। ‘ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন নেই’ অজুহাতে হাসপাতালে আগত রোগীদের ডিজিটাল এক্স-রে করাতে বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। রোগীরা অভিযোগ করেছেন, এক্স-রে এবং প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের ডাক্তাররা হাসপাতালের সামনের বেশ কয়েকটি ডিজিটাল এক্সরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। টেকনিশিয়ানদের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় এ হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন কেনা হয় না। হাসপাতালের আন্তঃ ও বহির্বিভাগের রোগী, তাদের স্বজন এবং চিকিৎসক, নার্স কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রন্ধে রন্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি আর দলবাজি গ্রাস করে আছে দক্ষিণাঞ্চলের আধুনিক চিকিৎসার ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আয়াদের বিরুদ্ধে রোগীদের ফুঁসলিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে কমিশনের বিনিময়ে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় নার্স থাকলেও রোগী সেবায় তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। একই অবস্থা চিকিৎসকদের বেলায়ও। সিনিয়র চিকিৎসকরা বাইরের ক্লিনিকে, ডায়াগনস্টিকে আবার কেউ ব্যস্ত ব্যক্তিগত চেম্বারে। হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা দেয় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তাদের আনাড়ি চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার ঘটনায় অনেক সময়ই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। অপারেশন থিয়েটারেও (ওটি) একই অবস্থা। হাসপাতালে যে সংখ্যক অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকার কথা, বাস্তবে তা নেই। কারণ সরকারি হাসপাতালের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়েই চলছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স এবং ক্লিনিক। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীদের মাসোহারা দিয়ে সরকারি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডারের হদিস নেই বলেও জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র। জানাগেছে, দু’একটি ছাড়া রোগ পরীক্ষার এমন কোনো যন্ত্র নেই যা এই হাসপাতালে নেই। কিন্তু নানা ছলচাতুরীতে বছরের বেশির ভাগ সময় সেগুলো অকেজো করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। শত কোটি টাকার ভারী যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেই কোনো প্রকৌশল বিভাগ। ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক একটি যন্ত্র বিকল হলে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ এসে সেটি মেরামত করতে অনেক সময় মাসও কেটে যায়। এই ফাঁকে যোগসাজশে লাভবান হন রোগ পরীক্ষার ব্যবসায়ীরা। অভিযোগে আরও জানা যায়, দলীয় প্রভাবের কারণে হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী দিনের শুরুতে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন ব্যবসা, রোগীর দালালিসহ আয়বর্ধক ধান্ধা নিয়ে। প্রতিটি শিফটে ৫-৬ জন করে নার্স প্রতিটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও বাস্তবে ২-৩ জনের বেশি থাকেন না। হাসপাতালে বিত্তবান রোগীদের জন্য ভাড়ার বিনিময়ে বিশেষ শয্যার (পেয়িং বেড) ব্যবস্থা রয়েছে। এ ভাড়ার টাকার সঙ্গেই রয়েছে তাদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা। কিন্তু পেয়িং কেবিন ও পেয়িং বেডে থাকা রোগীরা কখনোই হাসপাতালের খাবার পান না। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব দূরবস্থার বিষয়ে ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই হাসপাতালে গড়ে রোগী থাকে প্রায় ১৫০০। চেষ্টা থাকা সত্বেও রোগীদের অতিরিক্ত চাপের কারনে চাহিদা অনুযায়ী সেবা দেওয়া সব সময় সম্ভব নয়। এবিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা: বাকির হোসেন বলেন, বিগত দিনের সমস্যা গুলো কাটিয়ে উঠার জন্য আমি সর্বাত্বক চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে কোন কর্মচারী ও কর্মকতার বিরুদ্ধে সুনির্দিস্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান এই বৈষম্য মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে। রোগে আক্রান্ত ও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে মধ্যবিত্তরা দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে। আর দরিদ্ররা হচ্ছে নিঃস্ব।
Post Views:
১,৪৮৯
|
|