|
গাঁদা, গোলাপ, জিনিয়া, ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস, আরও কতো কি ?
তিন উৎসবকে ঘিরে চনমনে বরিশালের ফুল বাজার
মহান ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী। সাথে বসন্তবরণ ও ভ্যালেন্টাইনস ডে উৎসব। ফেব্রুয়ারী মাসের তিন উৎসবকে সামনে রেখে বরিশালের ফুলবাজারের বেচাকেনা বেশ জমে উঠেছে। ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ফুলচাষী, পাইকার ও শ্রমিকরা। চলতি মৌসুমে ফুলের উৎপাদন ভালো হওয়ায় বেচাকেনাও ভালো হবে বলে আশা করছেন ফুল চাষীরা। বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে বরিশালের বানারীপাড়া ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী দুই উপজেলায় দীর্ঘদিন থেকে ব্যাপক হারে ফুল চাষ হয়ে আসছে। এ দুই উপজেলার প্রায় পাঁচ’শ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করা হয়েছে। বানারীপাড়ার উদয়কাঠী এলাকার চাষীরা জানান, চলতি মৌসুমে প্রায় দশ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে। স্বরূপকাঠী উপজেলার চাষীরাও এমন লাভের আশা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সন্ধ্যা নদীর চিরাপাড়া এলাকায় প্রতিবছর মৌসুমের শুরু থেকেই ফুলের চারার ভাসমান হাট বসে। শীত ও বর্ষায় উপকূলীয় এলাকাগুলোর হাটবাজারে বিকিকিনি হয় এ হাটের ফুলের চারা। নদীর চিরাপাড়া এলাকা ছাড়াও কচুয়াাকাঠী মোহনায় বসে ভাসমান ফুলের চারার হাট। এ হাটের ব্যবসায়ীরা জানান, নেছারাবাদ উপজেলার অলংকারকাঠী ও সংগীতকাঠীতে রয়েছে দেশি-বিদেশী নানা জাতের ফুলের চারার নার্সারি। সেখান থেকে গাঁদা, গোলাপ, জিনিয়া, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ ২০ থেকে ২৫ জাতের ফুলের চারা সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করা হয়। তবে বেশি বেচাকেনা হয় ভাসমান হাটে। প্রতি শীত মৌসুমে হাটে কয়েক লাখ টাকার চারা বিক্রি হয়। এদিকে গত বছরের মত এবারও নগরীর ফুল ব্যবসায়ীরা ব্যপক লাভের আশা করছেন। গত বছর রেকর্ড পরিমান টাকা বিক্রি করা হয়েছে। একদিনেই বিক্রয়মূল্যে ১৫ লাখে নিয়ে গেছেন নগরীর ফুল ব্যবসায়ীরা। এবারও রেকর্ড পরিমান টাকার ফুল বিক্রি করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। বরিশাল নগরীর ফুল ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দরা জানান, নগরীতে পেশাদার নয়টি ফুলের দোকান রয়েছে। গতবছর ফুল প্রেমীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিলো। তাই প্রথমবারের মতো এতো ফুল বিক্রি হয়েছিলো। এবারও রেকর্ড পরিমান ফুল বিক্রির আশা করেছেন তারা। সরেজমিনে দেখা গেছে, চলতি ফেব্রুয়ারী মাসের তিন উৎসবকে ঘিরে ইতোমধ্যে নগরীর ফুলের দোকানগুলো বাসন্তি, হলুদ গাঁদা এবং ঝারবালাসহ বিভিন্ন ফুলে ভড়ে উঠেছে। উৎসবের দিন যতো ঘনিয়ে আসছে দামও হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বসন্ত উপহার গ্লাডিওলাস : বরিশালে এবারের বসন্তেও দারুণ উপহার নিয়ে এসেছেন ফুলচাষীরা। গত তিনমাস ধরে নিবিড় পরিচর্যায় সদর উপজেলার পাঁচজন কৃষক বরিশালের প্রকৃতিকে ভরিয়ে দিলেন গ্লাডিওলাস ফুলের সৌন্দর্য্যে। বিদেশী এই ফুলটি এতোবছর একচেটিয়াভাবে উৎপাদন হতো বাংলাদেশের যশোর জেলায়। বরিশালের ফুল বাজারেও এর চাহিদা প্রচুর। গোলাপ, রজনীগন্ধার পরেই গ্লাডিওলাস। ফুলের এ মৌসুমেই গ্লাডিওলাসের প্রতিটি স্টিক বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে। বরিশাল সদর উপজেলার কড়াপুর গ্রামের কৃষক হোসনে আরা বেগম, করমজা গ্রামের গিয়াসউদ্দিন লিটু, কর্ণকাঠীর ছালাম আকন, সাগরদীর আনিছুর রহমান, রূপাতলীর শহিদুল ইসলাম তাদের দুই থেকে পাঁচ শতক করে জমিতে এ ফুলের চাষ করেছেন। বরিশালে গত নভেম্বর মাসে এ ফুলের চাষ শুরু হলেও চলতি ফেব্রুয়ারী মাসের শুরু থেকেই ফুল দিতে শুরু করেছে।
ফুল চাষে নারীদের ভাগ্য বদল : বরিশাল ও পিরোজপুরের দুই উপজেলায় ব্যাপক হারে ফুলের চাষ হচ্ছে। এ দুই উপজেলার প্রায় ৫০০ হেক্টরেরও অধিক জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। তবে ব্যাংক ঋণ, নায্য মূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক, হিমাগার, পরিবহন, প্যাকেজিং সুবিধা না পাওয়ায় এই উদ্যোগ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুই উপজেলার প্রায় দুই হাজার নার্সারির অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। এখাতে অন্তত পাঁচ হাজার নারী কর্মরত রয়েছেন। ফলে নারীদের জীবন-মানেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। স্বরূপকাঠী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার এক হাজার ৭৮৩ নার্সারিতে চলতি মৌসুমে ৪৮৪ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে। বানারীপাড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবছর উপজেলায় ৬৮টি নার্সারির ৩২একর জমিতে ফুল চাষ করা হয়েছে। স্বরূপকাঠীর বৈশাখী নার্সারির মালিক শাহাদাত হোসেন জানান, তিনি তিন একর জমিতে গাঁদা, জিনিয়া, গ্লাডিওলাস, গোলাপসহ শীত ও গ্রীস্মকালীর উপযোগী ফুলের চাষ করছেন। তার নার্সারির অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। বানারীপাড়ার উদয়কাঠীর সুকন্যা নার্সারির মালিক সুফলা রানী জানান, তিনি এক হেক্টর জমিতে গাঁদা ও গ্লাডিওলাস, জিনিয়াসহ মৌসুমী ফুলের চাষ করেছেন। তিনি আরও জানান, প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয়ে ফুল চাষ করা হলেও ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় তিনি এ ব্যবসার প্রসারতা বাড়াতে পারছেন না। ফুল চাষ করে এসব গ্রামের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। ফুল ও ফুলের চারা চাষাবাদের সাথে এসব গ্রামের প্রায় তিন হাজার শ্রমজীবী মানুষ জড়িত থেকে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। এরমধ্যে অধিকাংশই নারী। পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা প্রতিদিন এখান থেকে নানাজাতের ফুলসহ চারা ক্রয়ে করে ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন।
মৌসুমী ফুল চারার ভাসমান হাট : শীতে ফোটে নানা প্রজাতির ফুল। ফুলপ্রেমীরা এ মৌসুমে এসব ফুলের চারা সংগ্রহ করে। গাঁদা, বেলী, জুঁই, চামেলী আর রজনী গন্ধা ফুলের মৌসুমে ঘরের শোভা বাড়িয়ে দেয়। ফলে বাণিজ্যিভাবে মৌসুমী ফুলের চাষও সম্প্রসারিত হচ্ছে। পিরোজপুরের কাউখালীতে সাপ্তাহিক দুইদিনের হাটে বসে শীতের ফুলের চারার পসরা। নৌকায় করে ভাসমান এ হাটে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার লাখ টাকার ফুলের চারা বিক্রি হয়। এখান থেকে ফুলের চারা ক্রয় করেন ফুলপ্রেমীরা। বিক্রি হয় পাইকারীও। পাইকারী ক্রেতারা উপকূলীয় হাট-বাজারে খুচরা বিক্রয় করেন এসব ফুলের চারা। কাউখালী শহরের সন্ধ্যা নদীর কচুয়াকাঠী মোহনায় ভাসমান নৌকায় বসে শীতের বাহারী ফুলের হাট। ফুলসহ গাছের চারার চাহিদা বেশি থাকায় ফুলের চারার চাষীরা ফোটা ফুলসমেত চারা উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। প্রতিটি চারা পলিথিনের প্যাকেটে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ফলে চারা থেকে মাটি ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। ক্রেতা ওই পলিথিন কেটে টব অথবা মাটিতে রোপন করে থাকেন। নার্সারির মালিকরা জানান, শুধু শীত মৌসুমেই নয়, সারা মৌসুমজুড়ে এখানে নার্সারির আবাদ চলে। এখানে নানা প্রজাতির ফুলের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস, পাতাবাহার, শোভন ঘাস, ঘাস ফুল, ডালিয়া, কসমস, সালবিয়া, স্টার, জিনিয়া, সূর্যমুখী, ক্যাপসিক্যাপ, ক্যাবিষ্ট, গ্যাজোনিয়া, ক্যারোনডোনা, স্যালোসিয়া, রজনীগন্ধা, গ্যালোডিয়া, নয়নতারা, চন্দ্রমল্লিকা, ইনকাগাঁদা, গোলাপ চারাও উৎপাদন করা হয়।
স্বাবলম্বীদের কথা : বানারীপাড়া উপজেলার শতাধিক পরিবার দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছের চারা উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ফুল গাছের চারা উৎপাদনকারীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে স্বরূপকাঠীর কৃষ্ণকাঠী গ্রামের শাহাদাৎ হোসেন নিজ উদ্যোগে মাত্র ২০ শতক জমিতে একটি নার্সারী করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করেন। শুরু থেকেই শাহাদাতের সফলতা আসতে শুরু করে। পরবর্তীতে তিনি নার্সারির প্রসরতা বৃদ্ধি করেন। শাহাদাতকে অনুসরন করে উপজেলার স্বরূপকাঠী, কৃষ্ণকাঠী, অলংকারকাঠী, সংগীতকাঠী, মাহমুদকাঠীসহ বিভিন্ন গ্রামের চাষীরা বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছের চারাসহ নার্সারীর ব্যবসায় ঝুঁকে পরেন। বর্তমানে এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়েছে পার্শবর্তী জেলা ঝালকাঠিতেও। উৎপাদিত এসব ফুলের চারা বর্তমানে বিক্রির জন্য বিভাগ ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। ফুল চারা উৎপাদনকারী শাহীন, সোলায়মান, অচিন্ত কুমার জানান, বছর জুড়ে প্রায় সব নার্সারীতেই দেশি-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির উৎপাদিত ফুল চারা বিক্রি করে মুনাফা বেশি হওয়ায় তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। নার্সারীগুলোতেই দেশি-বিদেশী গোলাপ, সূর্যমুখী, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমসসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাঁদাসহ ৩০ প্রজাতির ফুলের চারা উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত চারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়। যা থেকে চাষীরা প্রতিবছর প্রায় কোটি টাকা আয় করছেন। অল্প পুঁজিতে অধিক লাভ হওয়ায় ফুলের চারা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন শত শত নারী-পুরুষ। সরকারের সঠিক পৃষ্টপোষকতা পেলে ফুল চারা উৎপাদনে জড়িত চাষীরা তাদের এ পেশার প্রসরতা বৃদ্ধি করতে পারবেন বলেও উল্লেখ করেন।
শামীম আহমেদ, অতিথি প্রতিবেদক
Post Views:
২৬০
|
|