|
আমু ‘নিশ্চিত’ আ. লীগে বিএনপিতে এক ডজন
ঝালকাঠি-২ আসনে নির্বাচনী হাওয়া
ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-২ আসনে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দুটি পৌরসভা ও ২০টি ইউনিয়নের এ আসনে গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শহরের রেস্টুরেন্ট ও পার্কের আড্ডায় আলোচনার বিষয় একটাই। আর সেটা হলো আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত বলে দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করছে। অন্যদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এক ডজন। মনোনয়ন পেতে এরই মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ : জাতীয় সংসদের ১২৬ নম্বর নির্বাচনী এলাকাটিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগে কোনো গ্রুপিং নেই। দুই উপজেলায়ই শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ। নলছিটিতে প্রতি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কমিটি রয়েছে। অন্যদিকে ঝালকাঠি সদরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা সব সময়ই ভালো। এমনকি এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসনামলেও ঝালকাঠি পৌর এলাকায় নৌকা প্রতীকে বেশি ভোট পড়ত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আমির হোসেন আমু টেকনোক্র্যাট কোটায় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এ সময় তিনি নলছিটি ও ঝালকাঠিতে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ২০০০ সালে এ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আমির হোসেন আমু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আরো বাড়ে। ঝালকাঠি সদর আসন থেকে আমির হোসেন আমুই প্রথম পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন। তাই ঝালকাঠি জেলাজুড়ে তাঁর ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাঁর সঙ্গে রয়েছে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সমর্থন। ফলে এ আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটের পাল্লায়ই ভারী হয়েছে। ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার মো. শাহ আলম বলেন, ‘আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নাম জেলা কমিটিতে অনুমোদন করে কেন্দ্রে পাঠানো হবে। দলের মনোনয়ন পেতে অন্য কোনো আগ্রহী ব্যক্তির নাম এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। তাই বলা চলে আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেতে আগামী নির্বাচনে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।’ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নৌকায় ভোট চাইতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এলাকার নানা উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরে আগামীতে আরো কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু নিজেও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আগামী নির্বাচনে জনসাধারণকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। কখনো কখনো হাত তুলে শপথ করাচ্ছেন। ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ পনির বলেন, ‘সাংগঠনিকভাবে এখানকার আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপ নিয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো নতুন করে গঠন করা হচ্ছে। দলকে আরো গতিশীল রাখার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নেই আমরা যাচ্ছি।’ উন্নয়নের বর্ণনা দিয়ে সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের গত দুই মেয়াদে ঝালকাঠি জেলায় হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। তাই খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তরাও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর হাত ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমরা ঝালকাঠির দুটি আসন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে পারব।’ নলছিটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নলছিটি পৌরসভার মেয়র তছলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নলছিটির মানুষ আমির হোসেন আমুর সঙ্গে থাকবে। তাঁর হস্তক্ষেপে নলছিটি শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লাইন স্থাপন, নলছিটি উপজেলা হাসপাতাল ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। নলছিটি পৌর এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে।’ বিএনপি : আওয়ামী লীগে একক প্রার্থী থাকলেও বিএনপির চিত্র উল্টো। এ আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ডজনখানেক। ঝালকাঠি ও নলছিটিতে বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল দলটির পিছু ছাড়ছে না। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের জেলা শাখার আহ্বায়ক আব্দুল বারেককে পাশ কাটিয়ে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় মুসলিম লীগ থেকে সদ্য দলে আসা আব্দুর রবকে। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের আহ্বায়ক সিদ্দিক হোসেনকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় ওই সময় ঝালকাঠি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির নেতা ব্যবসায়ী গাজী আজিজ ফেরদৌসকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মনোয়ন দেওয়া হয় নির্বাচনের কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টি থেকে দলে আসা এ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্ত্রী ইসরাত সুলতানা ইলেনকে। বর্তমানে ঝালকাঠি বিএনপিতে কোন্দল রয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিরোধ টিকিয়ে রাখছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দলের অনেক সমর্থক বলছে, আগামী নির্বাচনকে ঘিরে ডজনখানেক ব্যক্তি মনোনয়ন চাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও যোগ্য প্রার্থীর সংকট রয়েছে। এ সংকট শুধু একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নয়, এর আগেও যতগুলো সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে সবটিতেই হঠাৎ দলে আসাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে এ আসনে যাঁরা বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন এবং কেন্দ্রে তদবির করছেন বলে নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সহসভাপতি মিয়া আহমেদ কিবরিয়া। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মিঞা আহমেদ কিবরিয়া দলের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নেন। তিনি স্থানীয় দলের আনুষঙ্গিক খরচও বহন করছেন। কর্মসূচি পালন করতে এসে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েও হাল ছাড়েননি তিনি। গাড়ি পোড়ানোসহ বেশ কয়েকটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এখনো আদালতে হাজিরা দিচ্ছে তিনিসহ নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন দৌড়ে আরো আছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) মাহবুবুল হক নান্নু, বর্তমান ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সভাপতি মোস্তফা কামাল মন্টু, সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নূপুর, সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কেন্দ্রীয় নেতা নূরুল ইসলাম বাবুল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য জেবা আহমেদ খান, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা জেলা বিএনপির সহসভাপতি ফারুক আহমেদ, জেলা যুবদলের সভাপতি এম কামরুল ইসলাম, ঝালকাঠি পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপির প্রয়াত সংসদ সদস্য গাজী আজিজ ফেরদৌসের ছোট ভাই আব্দুল হালিম গাজী ও গোলাম মোস্তফা ছালু। অন্যদিকে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন জেলা জামায়াতের আমির হাফিজুর রহমান ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক জামাল উদ্দিন। জেলা বিএনপির সহসভাপতি মিঞা আহমেদ কিবরিয়া বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য আমরা সব সময় তৈরি। আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সভা করে নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মামলা-হামলার ভয় করি না। বর্তমানে ১৪-১৫টি মামলায় আমরা কয়েক হাজার নেতাকর্মী আদালতে হাজিরা দিচ্ছি। আমি দল করতে এসে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছি, বাস পোড়ানো মামলা দিয়ে আমাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। কর্মসূচি পালন করতে এসে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছি। আশা করি দল আমাকে নির্বাচনের সময় পুরস্কৃত করবে।’ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নূপুর বলেন, বিএনপি তৃণমূলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শক্তিশালী একটি দল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দলটিকে প্রকাশ্যে বড় ধরনের কোনো সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না পুলিশ। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে তাঁরা তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হচ্ছেন জানিয়ে নূপুর বলেন, ‘যারা ঢাকায় থেকে আগামী নির্বাচনে বসন্তের কোকিলের মতো এসে মনোনয়ন হাসিল করতে চায়, নেতাকর্মীদের সঙ্গে যাদের কোনো যোগাযোগ নেই, আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো ভূমিকা নেই, তারাই দলের মধ্যে কোন্দল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এদের প্রতিহত করার জন্য আমরা জেলা বিএনপির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করব।’ তিনি আরো বলেন, ‘২০০৮ সালে নির্বাচনের পর সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো আমাদের অথৈ সাগরে ফেলে পালিয়ে গেছেন। তিনি এখন আর বিএনপির সঙ্গে নেই। বিএনপির নমিনেশন চাওয়ার নৈতিক অধিকার তাঁর নেই। তাঁকে নমিনেশন দিলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করবে।’ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূপুর আরো বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের (২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ) পর দল চালাতে আমাকে সহায়তা করেছেন সহসভাপতি মিয়া আহমেদ কিবরিয়া। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তিনি। এর পরও দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, আমরা তাঁকে বিজয়ী করতে কাজ করব।’ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় অনেকে পালিয়ে গেলেও আমি তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। সেই কারণে দেশনেত্রী আমাকে মূল্যায়ন করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দিয়েছেন। যাঁরা দলের মনোনয়ন চাইছেন তাঁরা সাংগঠনিক ও তৃণমূলে জনপ্রিয় কেউ নন। দলের ত্যাগী নেতাকে মনোনয়ন দিলে এসব গ্রুপিং আজ থাকত না। এর আগে ঝালকাঠি-২ আসনে যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁরা এখন আর বিএনপিতে নেই। হালুয়া-রুটি খাওয়া শেষ, এখন আর নেতাকর্মীদের খোঁজও নিচ্ছেন না তাঁরা।’ যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী আমির হোসেন আমুকে পরাজিত করে আসনটি ফিরে পাওয়া যাবে বলে মনে করেন মাহবুবুল হক। জাতীয় পার্টি : এ ছাড়া ঝালকাঠি-২ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে আলোচনায় রয়েছেন দলের জেলা সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক এম এ কুদ্দুস খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার নেতৃত্বে ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি উপজেলার দুটি পৌরসভা এবং ২০টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরশাদের ঘাঁটি হিসেবে ঝালকাঠি-২ আসন পরিচিত। আগের চেয়ে এখানে দল শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে দলের অথবা জোটের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই নির্বাচিত হতে পারব।’
সূত্রঃ কালের কন্ঠ
Post Views:
০
|
|