|
বাড়ির ছাদের ওপর এখন বাগানে শতাধিক গাছ রয়েছে, বলেন মোসফেকা বেগম
ছাদবাগান ভুলিয়ে দিয়েছে দুরারোগ্য ব্যাধির কথা !
পি কে চয়ন : স্বামী প্রয়াত সামসুল আলম তালুকদারের ১৯৯৮ সালের ২০ জুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিলো। স্বামীর মৃত্যুতে সবকিছু যেন এলেমেলো হয়ে যায়। সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা ছিলেন তৎকালীন বরিশাল সিটি কলেজের বায়োলজির প্রদর্শক মোসফেকা বেগম। সংগ্রামে জীবনের চাকা ঘুরে দাঁড়ানো চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে জানতে পারেন নিজের শরীরেও বইছে ক্যান্সারের জীবাণু। তবে স্বামীর মতো পেটে (স্টোমাক) ক্যান্সার নয় তিনি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। তারপর থেকে ‘ক্যান্সার হলে মৃত্যু ছাড়া নাই উপায়’- এ কথাটি যেন বার বার তার কানে বেজেই চলছিলো। জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা এই নারীর জীবনের চাকা যেন থমকে দাঁড়ায়। মৃত্যুর প্রহর গুনতে শুরু করেন সর্বোদাই। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের একটি শখ, চিকিৎসকের একটি কথা আর স্বজনদের প্রেরণাকে পুঁজি করে তৈরি করেন নিজ বাড়ির ছাদের ওপর একটি বাগান। যেই বাগানই অবসর জীবনেও তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে দূরারোগ্য ব্যাধির কথা। ক্যান্সার রোগে চিকিৎসাধীন ওই নারী দিন কাটাচ্ছেন গাছের লালন-পালন, হাসিমুখে প্রতিবেশী ও স্বজনদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা-পরামর্শ ভাগাভাগি করে। দেখলে বোঝার উপায় থাকবে না তিনি যে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছেন। বরিশাল নগরের ঝাউতলা প্রথম গলির সাদা রংয়ের ৩ তলা একটি বাড়ির মালিক ছিলেন বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক প্রকৌশলী প্রয়াত সামসুল আলম তালুকদার। যে বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করেন তার স্ত্রী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত মোসফেকা বেগম। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে সাজিয়া নুসরাত তানিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার তিনি স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ছেলে ফটোগ্রাফার মো. রাফি পড়াশুনা ও কাজের জন্য বেশিরভাগ সয়ম ঢাকায় থাকলেও বাড়িতে মোসফেকা বেগমের বর্তমান সঙ্গী ছেলের বউ বরিশাল ইসলামিয়া কলেজের প্রভাষক ফারাজানা আক্তার আর তাদের সহযোগী লাকি। তবে দিনরাত তার সময়কাটে বাড়ির ছাদের ওপর প্রায় ১ হাজার ৫শ স্কয়ার ফিটের ওপর তৈরি করা ছাদবাগানের নানান জাতের গাছপালা নিয়ে। শুধু ছাদেই নয় তৃতীয় তলায় তাদের নিজের ফ্লাটটিও সাজিয়েছেন নানান ধরনের গাছপালা দিয়ে। বিশেষ করে ক্যাকটাস ও অর্কিডের দেখা মিলবে ঘরের ড্রইং, ডাইনিং, শোবার রুমের বেলকুনিসহ বিভিন্ন স্থানে। মোসফেকা বেগম বলেন, ‘স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর সন্তানদের জন্য নিজেকে শক্ত করে তৈরিও করে ফেললাম। তারপর ২০১৪ সালের অক্টোবরে হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমি নিজেও ক্যান্সারে আক্রান্ত। তখনকার অবস্থাটা বোঝানো যাবে না। দিশেহারা হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টায় ছোটাছুটি শুরুকরি। দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলাম। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখে এক চিকিৎসক বললেন মাথা থেকে রোগ সরিয়ে ফেলো, তাহলেই তুমি ৭৫ শতাংশ রোগমুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যে রোগ মৃত্যুর কথা বলে দেয়, তাকি মাথা থেকে নামানো যায়? রোগের কথা যেন ভুলে থাকাতে পারি সেজন্য আত্মীয়-স্বজনরা নানান চেষ্টা শুরু করলেন’। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের দিকে ভগ্নিপতি বিএডিসি’র চেয়ারম্যান নাছিরুজ্জামান বাড়ির ছাদ দেখে বাগান করার পরামর্শ দেন। তার কথায় ছোটবেলার শখকে বাস্তবে রুপ দিলাম। বাগানের জন্য একা গিয়ে মাটি-সার-গাছ সবই সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। অবসর জীবনে এসে এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে নিজের অজান্তেই পুরো ব্যস্ত হয়ে গেলাম’। ‘চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসাধীন আছি। তবে গাছের পরিচর্যা লিপ্ত থেকে কখনো রোগের কথাই এখন মাথায় আসছে না। গাছই এখন আমার মাথায় ধ্যানের মতো হয়ে গেছে। ইবাদত বন্দেগির বাহিরে সকাল-বিকেল এমনকি রাতে ঘুমাতে গিয়েও চিন্তা করছি গাছের কথা’। বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে গাছ লাগিয়ে আসলেও ২০১৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এ বাড়ির ছাদের ওপর এখন বাগানে শতাধিক গাছ রয়েছে, বলেন মোসফেকা বেগম। তিনি বলেন তারা ছাদবাগানে বর্তমানে টমেটো, চেরি টমেটো, মরিচ, লাউ, বেগুন, আম, আমড়া, আঙ্গুর, ড্রাগন, মালবেরি, পেয়ারা, স্টবেরি, গোলাপ, বেলি, অ্যাডেনিয়ামসহ নানান প্রজাতির অর্কিড, ক্যাকটাস গাছ রয়েছে। এসব গাছের মধ্যে পেন্সিল অর্কিড, ডেনড্রোবিয়াম, ক্যাটেলিয়া প্রজাতির অর্কিড সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়েছে। ছাদে বাগান করাটা অনেক কষ্টকর জানিয়ে মোসফেকা বেগম বলেন, ছাদেবাগানে যা খরচ হয় তা ফিরে না পেলেও যখন বীজ থেকে বেড়ে ওঠা একটি গাছে ফলন ধরে ফসল উৎপাদন হয় তখন প্রাপ্তিটা অনেক হয়ে যায়। এখন গাছে যা পাই, অন্য কোথাও তা খুঁজে পাই না। এ কাজ করে ভালো আছেন বিধায় স্বজনরাও সবাই তাকে এই বাগান তৈরিতে সর্বোদা সহযোগীতা করছেন বলেও জানান তিনি।
Post Views:
১৩৯
|
|