শ্রীদেবীর আসল নাম শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গার আয়পান, তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নারী সুপারস্টার বলা হয়
কিংবদন্তি অভিনেত্রী শ্রীদেবী আর নেই !
মুক্তখবর ডেস্ক রিপোর্ট : ভারতের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শ্রীদেবী মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর। দুবাইয়ের স্থানীয় সময় শনিবার রাতে তিনি সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান চলাকালে হঠাৎ এই অভিনেত্রীর হৃৎদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এসময় শ্রীদেবীর স্বামী বনি কাপুর ও তাঁর ছোট মেয়ে খুশি সঙ্গে উপস্থিত ছিল। শ্যুটিং-এ ব্যস্ত থাকায় সঙ্গে ছিলেন না বড় মেয়ে জাহ্নবী। ঘটনা নিশ্চিত করে শ্রীদেবীর দেবর সঞ্জয় কাপুর বলেন,‘এটা সত্যি যে শ্রীদেবী মারা গেছেন। আমি মাত্রই আসলাম। ১১-১১:৩০ এর দিকের ঘটনা।’ শ্রীদেবীর আসল নাম শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গার আয়পান। তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নারী সুপারস্টার বলা হয়। কারণ তিনিই প্রথম ও একমাত্র অভিনেত্রী, যিনি দক্ষিণ ভারত এবং বলিউডে সমানভাবে সফল। ভিন্ন ঘরানা থেকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক, সব ধরনের ছবিতেই তিনি স্বাচ্ছন্দে অভিনয় করেছেন। ১৯৬৭ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয় শ্রীদেবীর। এরপর ১৯৭৫ সালে ১৩ বছর বয়সে ‘জুলি’ সিনেমায় অভিনয় করে তিনি সবার প্রশংসা কুড়ান। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে ‘সোলবা শাওন’ চলচ্চিত্রে চিত্রনায়িকা হিসেবে তাঁর অভিষেক হয়। শ্রীদেবীর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাদমা’ চলচ্চিত্রটি। এই সিনেমায় তাঁর অভিনয় দর্শকমনে আলাদা একটি জায়গা করে নেয়। এরপর আর তাঁকে থামায় কে? একে একে দর্শকদের উপহার দিয়ে গেছেন মাওয়ালি, মিস্টার ইন্ডিয়া, চাঁদনী, তোহফাহ, চালবাজ, লামহে, গুমরাহ, নাগিনা, জুদাই’র মত সব জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। স্বীকৃতিস্বরুপ ২০১৩ সালে পেয়েছেন ভারতের ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার। বিভিন্ন ভাষার প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।
রোববার ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আজকের সকাল ভারতবাসীর মন বিষাদে ভরে দিল। দেশটির চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শ্রীদেবীর অকালমৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সবাই। শ্রীদেবীর একসময়ের সহকর্মী অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে বর্তমানের তারকা—শোকে মুহ্যমান সবাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ রোববার সকালেই তাঁর শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধীর কার্যালয় এ অভিনেত্রী মৃত্যুতে জানিয়েছে তাদের শোক।
প্রধানমন্ত্রী মোদি টুইটারে তাঁর বার্তায় বলেন,‘খ্যাতনামা অভিনেত্রী শ্রীদেবীর অকালমৃত্যু আমাকে কষ্ট দিয়েছে। চলচ্চিত্রশিল্পের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে নানা ভূমিকায় স্মরণীয় অভিনয় করেছেন। তাঁর পরিবার এবং অসংখ্য ভক্তের প্রতি সমবেদনা জানাই। তাঁর পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনা করি।’
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর কার্যালয় টুইটারে শোক জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,‘শ্রীদেবীর হঠাৎ ও অকালমৃত্যুর ঘটনা শুনে আমরা শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছি। তিনি ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্রে কাজ করে তিনি সুনামের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর পরিবারের প্রতি সান্ত্বনা জানাই। তাঁর পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
খ্যাতনামা অভিনেতা কমল হাসান তাঁর শোকবার্তায় বলেছেন, সেই ছোটবেলা থেকে এক অসামান্য নারী হয়ে ওঠা শ্রীদেবীকে আমি দেখেছি। আজ মুহূর্তেই মনে পড়ছে শ্রীদেবীর সঙ্গে অনেক সুখস্মৃতি। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি মনে পড়ছে। “সাদমা”র কথা মনে পড়ছে। আমরা তাঁকে সত্যিই মিস করব।’
অভিনেতা থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া দক্ষিণের সুপারস্টার রজনীকান্ত টুইটারে শোক জানিয়ে লিখেছেন,‘আমি শোকাহত। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। আমি আমার এক প্রিয় বন্ধুকে হারালাম। আর চলচ্চিত্র জগৎ হারাল এক সত্যিকারের কিংবদন্তিকে।’
টুইটে প্রিয়াংকা চোপড়া লিখেছেন,‘ভাষা হারিয়ে ফেলেছি….যারা শ্রীদেবীকে ভালোবাসতেন, তাদের জন্য সমবেদনা…একটা অন্ধকার দিন এটা’।
রীতেশ লিখেছেন,‘ভয়ংকর এক খবর। শোকে ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শ্রীদেবী নেই…শান্তিতে ঘুমাক তাঁর আত্মা’।
তার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত শেষ হয়ে গেছে বলেও দুবাই সরকারের মিডিয়া অফিস এদিন টুইট করে জানিয়েছে।
তবে শ্রীদেবীর ময়না তদন্তে যে রকম অস্বাভাবিক সময় লেগেছে ও ‘বাথটাবে দুর্ঘটনাবশত জলে ডুবে মৃত্যুর’ যে কথা ফরেনসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, তার পর থেকেই তার মৃত্যুর পেছনে আসল রহস্যটা কী – তা নিয়ে জল্পনা চরমে উঠেছে।
তার স্বামী বনি কাপুরকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, এদিকেও ভারতেও অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন শ্রীদেবীর মৃত্যু মোটেও স্বাভাবিক ছিল না।
কিন্তু কেন ও কীভাবে এই মৃত্যুকে ঘিরে এত প্রশ্ন ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে?
গত শনিবার রাতে দুবাইয়ের বিলাসবহুল হোটেল জুমেরাহ এমিরেটস টাওয়ারের একটি অ্যাপার্টমেন্টে সুপারস্টার শ্রীদেবীর মৃত্যুর প্রায় বাহাত্তর ঘন্টা পর তার মরদেহ অবশেষে এদিন সন্ধ্যায় ভারতের উদ্দেশে রওনা হতে পারছে।
মৃত্যুর কারণ ও সঠিক সময় নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা ও বিবরণ, ফরেনসিক রিপোর্টে বাথটাবে জলে ডুবে মৃত্যুর উল্লেখ, দুবাইয়ের সরকারি কৌঁসুলিকে সোমবার রাতে এই মৃত্যুর তদন্তের ভার দেওয়া – সব মিলিয়ে গত তিনদিন ধরে শ্রীদেবীকে নিয়ে রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হয়েছে।
তবে এদিন বিকেলে দুবাই কর্তৃপক্ষ অবশেষে টুইট করে জানিয়েছে – এই ‘কেস ক্লোজড’!
সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নভদীপ সুরি এদিন জানান, “আমাদের টিম আগাগোড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে এবং পুলিশের কাছ থেকে অবশেষে ছাড়পত্রও মিলেছে। এখন স্বাস্থ্য বিভাগ ও ইমিগ্রেশন বিভাগের কিছু ফর্ম্যালিটি বাকি আছে, তারই কাজ চলছে।”
“নিয়মমাফিক সব পদ্ধতি শেষ করতে দুবাই সরকার তাদের সময় নিয়েছেন, এখন আমরা তার মরদেহ যত দ্রুত সম্ভব ভারতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
বেশি রাতে মুম্বাইতে শ্রীদেবীর মরদেহ পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং তার পরিবার আজ জানিয়েছে বুধবার বিকেল সাড়ে তিনটের সময় মুম্বোইয়ের ভিলে পার্লেতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
তবে দুবাই কর্তৃপক্ষ আপাতত ‘তদন্ত শেষ’ বলে জানিয়ে দিলেও শ্রীদেবীর মৃত্যু নিয়ে ভারতে মূল ধারার গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াতে যে পরিমাণ জল্পনা-কল্পনা চলছে তা প্রায় নজিরবিহীন।
৫৪ বছরের একজন সুস্থ-সবল মহিলা কীভাবে বাথটাবে জ্ঞান হারিয়ে ডুবে যেতে পারেন, তা নিয়ে অবিরাম প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
তার স্বামী বনি কাপুরকে দুবাই পুলিশ জেরা করায় এবং শ্রীদেবীর স্বামীর প্রথম পক্ষের সন্তান অভিনেতা অর্জুন কাপুর এদিন সকালে তড়িঘড়ি দুবাই পাড়ি দেওয়ায় মিডিয়ার সন্দেহ আরও দানা বেঁধেছে।
আর এরই মধ্যে আরও মারাত্মক অভিযোগ করেছেন বিজেপি নেতা ও এমপি সুব্রহ্মণ্যম স্বামী।
মি স্বামী বলছেন, “প্রথমে বলা হল হার্ট অ্যাটাক, পরে সেটা পাল্টে গেল। তারপর জানা গেল দুর্ঘটনা, বলা হল তার রক্তে না কি অ্যালকোহল ছিল। যে শ্রীদেবীকে আমরা জানতাম তার কোনওটার সঙ্গেই কিন্তু এগুলো যায় না।”
“আমি নিশ্চিত, এটা একটা হত্যাকান্ড – যদিও মোটিভটা কী, সেটা আমি জানি না। তবে সবাই জানে বলিউডের সাথে দুবাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক ঘনিষ্ঠ ও অস্বাস্থ্যকর যোগাযোগ আছে – হতে পারে এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে তারই সম্পর্ক আছে”, বলেন তিনি।
মধু কিশওয়ারের মতো অ্যাক্টিভিস্ট আবার প্রশ্ন তুলেছেন, শ্রীদেবীর কথিত ক্র্যাশ ডায়েট কোর্স ও জিরো ফিগার রাখার জন্য নানা ক্লিনিক্যাল চিকিৎসাই অকালে তার মৃত্যু ডেকে এনেছে কি না।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গুরজিৎ সিং আবার বলছেন, শ্রীদেবীর ফরেনসিক রিপোর্টই আসলে এই সব সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
দুবাইতে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করা মি সিং বলছিলেন, “সেখানে হাসপাতালের বাইরে যে কোনও মৃত্যুই পোস্ট মর্টেমের জন্য যায়। এ ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল না কি তার আইনগত প্রয়োজনীয়তা ছিল আমি জানি না – কিন্তু ঘটনা হল এই রিপোর্টে যেখানে সব অস্পষ্টতার উত্তর মিলবে বলে ভাবা হয়েছিল – দেখা গেল তার বদলে তা আরও বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে।”
শ্রীদেবীকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য মুম্বাই-সহ গোটা ভারত যখন অধীর উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করছে, তার মধ্যেও কিন্তু সেই বিভ্রান্তির রেশ রয়েই যাচ্ছে।
আর গত চব্বিশ ঘন্টায় ভারতে সোশ্যাল মিডিয়াতে সবচেয়ে ট্রেন্ডিং টপিকগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘বাথটাব’!
বরিশাল মুক্তখবর পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।
Post Views:
১১৭
|